![]() |
ভিআইপি বনাম অলৌকিকতা, www.educationpointbd.blogspot.com |
বরিশাল,
পটুয়াখালী ও বাউফলের দর্শনীয়
অনুষ্ঠানের পর আমরা ঢাকার
উদ্দেশ্যে রওয়ানা করি ।
রাস্তার অবস্থা ভাল থাকায়
আমরা যথাসময়ে মাওয়া ফেরি ঘাটে
এসে পৌঁছলাম । পদ্মা
সেতু নির্মান কাজের কারনে ফেরির
সংখ্যাও ছিল নগন্য ।
কিছু ফেরী ছিল চলাচলের
অযোগ্য । আমাদের
ফেরী বাতিল করা হয়েছে
এবং আমরা যখন জানতে
পারলাম যে শেষ ফেরী
চলে যাবে তখন অন্য
পাশে ছুটে গেলাম ।
এরই মধ্যে শেষ ফেরীতে
উঠার অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় ২০০
যানবাহন কিন্ত খালি আছে
মাত্র ৪ টি গাড়ি
রাখার যায়গা । আমাদের
গাড়ি এগিয়ে গেলে নিরাপত্তা
কর্মী আটকে দিয়ে বলল
‘শুধুমাত্র ভিআইপি’ ।
এরই মধ্যে দু’টি
গাড়ির জায়গা বুকড হয়ে
গেছে, একটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিসি ড. মো. ফায়েকুজ্জামান
এবং অপরটি খুলনার এমপি
মোস্তফা রশিদী সুজার জন্য
। নিরাপত্তাকর্মী আরো
দুটি ভিআইপি নির্বাচন করার
জন্য এগিয়ে এসেছিল কিন্তু
সেখানে আরো অন্তত ২০জন
ভিআইপি ছিল । সম্ভবত
সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের অনেকে
যাচ্ছিলেন । নিরাপত্তা
কর্মীর পক্ষে ভিআইপিদের চিহ্নিত
করা কঠিন হয়ে পড়েছিল,
যেকারনে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার
সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য তাদেরকে ভিজিটিং
কার্ড দিতে বলা হলো
। সবাই তাদের
ভিজিটিং কার্ড দিচ্ছিলেন এবং
আমার ড্রাইভার আমাকে আমার ভিজিটিং
কার্ড দিতে অনুরোধ করল,
কিন্ত আমি দিব কিনা
তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হলাম
কারণ আমিতো আর ভিআইপি
নই ।
আমি নোয়াখালীতে একটি দরিদ্র গ্রামে
জন্মগ্রহণ করেছি এবং ইংল্যান্ডে
কাজ করছি। আমার
সকল ভাই ও বোন
গ্রামে বাস করে, আমার
উচ্চপদে কোন আত্মীয়ও নেই
তাই আমি চুপচাপ বসে
ভাবছিলাম, আমারতো সব সুযোগই
ছিলো, আমি যদি ভিআইপি
হওয়ার জন্য আমার অর্জিত
অর্থ নিজের জন্য ব্যয়
করতাম তবে আমিও ভিআইপি
হতে পারতাম । কিন্ত
হায়, আমিতো অক্ষম, আমিতো
বঞ্চিত মানুষের শিক্ষার জন্য আমার জীবনকে
উৎসর্গ করেছি তাই আমি
তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আমার
ড্রাইভার আমাকে বলল, "স্যার
আপনার একটা কার্ড কি
আমাকে দেয়া যাবে?" আমি
ভাবলাম যে আমার কার্ডতো
কোন ভিআইপি স্ট্যাটাস বহন
করে না, এটাতে কেবল
উভয় দেশে ব্যবহারের জন্য
আমার নাম আর যুক্তরাজ্য
ও বাংলাদেশের ঠিকানা এবং টেলিফোন
নম্বর রয়েছে । তবুও
শুধু তাকে খুশি করার
জন্য আমি তাকে কার্ডটা
দিলাম । ড্রাইভার
কার্ডটি নিয়ে নিরাপত্তা কর্মীকে
দিলেন । নিরাপত্তাকর্মী
সব কার্ড গ্রহণ করে
ভিতরে গেলেন এবং কিছুক্ষণ
পরে তিনি আমাদের গাড়ির
কাছে এসে বললেন, "স্যার
আপনি আসতে পারেন" এবং
ফেরিতে যাওয়ার জন্য আমাদের ড্রাইভারকে
বললেন ।
কি ঘটতে যাচ্ছে আমি
তা বুঝে উঠার আগেই
আমরা ফেরিতে চড়লাম ।
প্রত্যেকেই আমাদের দিকে তাকিয়ে
ছিল । আমাদের
গাড়িও তত দামী ছিলনা
না আর এটা ছিল
একটা ভাড়া গাড়ি।
আমি গাড়িতে বসে ভাবছিলাম, আগামীকাল
যদি আমার ফ্লাইট না
হতো তাহলে আমি মাওয়া
গেস্ট হাউজে আথবা আশে
পাশে কোথাও থেকে যেতাম। বাংলাদেশতো
আর ১৫/২০ বছর
আগের মত নেই ।
অনেক উন্নত হয়েছে, অনেক
সুবিধা বেড়েছে ।এরই
মধ্যে এক নিরাপত্তাকর্মী আমার
জানালায় টোকা দিয়ে তার
সঙ্গে ভিভিআইপি রুমে যাওয়ার জন্য
আমাকে অনুরোধ জানাল। আমার সঙ্গীরা একটু
চিন্তিত হলো কিন্তু ভিভিআইপি
রুমটি দেখার জন্য আমি
কৌতুহলী হয়ে তাকে অনুসরণ
করলাম । তিনি
আমাকে বসার জন্য আসন
দেখিয়ে দিলেন, ভিসি সাহেব আগে
থেকেই সেখানে আছেন ।
আমরা নিজেদের মধ্যে পরিচিত হয়ে
নিলাম এবং একে অপরের
সম্পর্কে জানলাম । তিঁনি
তাঁর ছাত্র জীবনের এবং
কিভাবে ভিসি হলেন এসব
কিছু কথা শেয়ার করলেন
।
![]() |
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. ফায়েকুজ্জামান
ও সাংসদ মোস্তফা রশিদী সুজা সহ।
|
আমরা দু’জন যখন
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আলোচনা
করেছিলাম, তখন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ
সংসদ সদস্য সুজা সস্ত্রীক
রুমে প্রবেশ করেন ।
আমি বুঝতে পেরেছি তারা
একে অপরের পূর্ব পরিচিত
কারণ তারা প্রায়ই এই
রুটটিতে ভ্রমণ করে ।এমপি সুজা ও
তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হলাম
। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত
নম্র ও বিনয়ী ।
এমপি সুজা কিছু খাবারের
অর্ডার দিলেন, ফেরির এ
ভিআইপি রুমটি অনেকটা পাঁচ
তারকা হোটেলের লাউঞ্জের মত ছিল, খাবার
পরিবেশনও ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন এবং আমি সবকিছুই
উপভোগ করছিলাম কারণ বাংলাদেশে ভ্রমনপথে
খাওয়ার উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়া
খুবই কঠিন ব্যাপার ।
পরে আমি আবিষ্কার করলাম
যে এই ফেরিতেই মাঝে
মাঝে বাংলাদেশের শীর্ষ ভিভিআইপি ভ্রমণ
করেন। এমপি
সুজা আমার সম্পর্কে কৌতুহলী
হলেন, অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস
করলেন, কতদিন আমি ইংল্যান্ডে
বসবাস করছি, আমি কি
করি, আমার জন্ম কোথায়,
কেন আমি সাংবাদিকদের কম্পিউটার
দিচ্ছি । আমি
সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম, তাঁর
স্ত্রী, উপাচার্য এবং অন্যান্য ভদ্রলোকেরা
চুপচাপ শুনছিলেন । ফেরি
যাত্রার দুই ঘন্টা সময়
খুব দ্রুতই কেটে গেল। কথাবার্তার
শেষ পর্যায়ে আমরা মাওয়া ঘাটের
অপর দিকে পৌঁছে গেলাম
।
আমরা পরস্পর থেকে আলাদা
হওয়ার আগে তাঁরা আমাকে
খুলনা যেতে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন,
আমিও তাদেরকে ইংল্যান্ডে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম
। আমাদের গাড়ি ঢাকার
পথ ধরে সামনে এগিয়ে
যাচ্ছিল কিন্ত, পিছনের ঘটনাগুলি
আমার কল্পনায় ফিরে আসছিল ।
আমি সবিস্ময়ে নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম, এটি কিভাবে
ঘটেলো ? এটা কি আল্লাহর
কাছ থেকে একটি অলৌকিক
ঘটনা বা আমার পিতামাতার
কাছ থেকে পাওয়া কোন
আশীর্বাদ, নাকি আমি যাদের
জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি
তাদের আশীর্বাদ ? আমার ইচ্ছা হলো
নিরাপত্তাকর্মীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি,
কেন তারা আমাকে বেছে
নিল, আমিতো কোন ভিআইপি
নই । কিন্ত
এখন আর এটা সম্ভব
নয় কারন পরের দিনই
আমাকে লন্ডনে ফিরে যেতে
হবে, তাই রহস্য থেকেই
যাবে।
আমি অনুভব করলাম, আমি
দেশকে যা দিয়েছি দেশতো
আমাকে তার চেয়েও বেশি
দিয়েছে । মাতৃভূমি
হলো মায়ের মত ।
একজন মা তাঁর সন্তানের
জন্য যাকিছু করেন তাও
আল্লাহর সৃষ্টি এক অলৌকিক
বিষয় ।অলৌকিকতার
পেছনের কারন খুঁজে বের
করা আসলে কারও পক্ষেই
সম্ভব নয় । তাই
আমিও বিষয়টি মেনে নিয়ে
ঢাকার দিকেই মনোনিবেশ করেছি
। আমাদের গাড়িটি
হাতিরঝিল অতিক্রম করে গুলশানে ঢুকছিল,
চেক পোষ্ট আমাদের গাড়ি
থামিয়ে দিল এবং গাড়ির
জানালা খুলতে অনুরোধ করল
। তার কিছু
প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর
আমাদেরকে যেতে দিল ।
গুলশান ও বারিধারা এমন
একটি জায়গা যেখানে বাংলাদেশের
অধিকাংশ ভিআইপি বসবাস করে,
তাই কেউ যদি ভিআইপি
নাও হন তবে তাকেও
এ এলাকার সব প্রবেশ
পথে প্রায়ই চেকপোস্টের আনুষ্ঠানিকতা মোকবেলা করতে হয় ।
আমার বাড়িও ভিআইপিদের বাড়ি
দ্বারা বেষ্টিত । একদিকে
সরকারি মালিকানাধীন একটি বাড়ি যেখানে
একজন মন্ত্রী বসবাস করেন, সামনে
থাকেন সাবেক একজন প্রধান
বিচারপতি এবং অন্যদিকে থাকেন
একজন নির্বাচন কমিশনার । কিন্তু
আমার বাড়ীতে বসবাস করছে আমার
পছন্দের কিছু বঞ্চিত ও
অবহেলিত শিক্ষার্থী । আমি
তাদেরকে গ্রাম থেকে নিয়ে
এসেছি এবং ঢাকায় বিভিন্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ করে
দিয়েছি । আমি
আজ রাতে তাদের সঙ্গেই
কাটাব এবং আগামীকাল ইংল্যান্ডে
ফিরে যাব আর ভিআইপি
হওয়ার জন্য অন্য একটি
অলৌকিক ঘটনার অপেক্ষায় থাকব।
নিবন্ধটি
ড. নূরুল করিম, বার্মিংহাম,
যুক্তরাজ্য এর ইংরেজিতে লেখা নিবন্ধ থেকে
অনুদিত
![]() |
ড. নূরুল করিম, বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য |