Thursday, February 29, 2024

অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী স্মরণে।

 মরহুম অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী স্মরণে।

অধ্যক্ষ এম এ বারী
ছবিটি স্যারের জৈষ্ঠ পুত্র জনাব
সাজ্জাদুল বারী’র নিকট থেকে সংগৃহীত। 
আমার প্রথম বস অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী। আজ থেকে ঊনত্রিশ বছর আগে যাঁর অধীনে শিক্ষকতা শুরু করতে পেরে আজও গর্ব বোধ করি।
আজ ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ।
বামনী কলেজ'র প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী স্যার এর ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী । মরহুম বারী স্যারকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরন করছি ।

দিনটি ছিল ১৯৯৫ সালের ২৩ জুলাই ।
আগে তাঁকে কখনও দেখিনি। সেদিনই স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা । দিনটি ছিল বামনী কলেজ প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রথম ইন্টারভিউ। শিক্ষক নিয়োগের ইন্টারভিউ হলেও আয়োজনের অবয়ব, লোকজনের উপস্থিতি, শতাধিক লোকের দুপুরে মেজবানি খাবার ব্যবস্থা এসব কিছু দেখে সেটাকে যে কেউ ছোট খাটো বিয়ে, খৎনা বা আকিকার অনুষ্ঠানও মনে করতে পারতো । বামনী কলেজের অফিসিয়াল জন্ম ১৯৯৪খ্রী.। আজকের পূর্ন যৌবনা বামনী কলেজের জন্ম হয় মূলত বামনী হাই স্কুলের পুরোনো ক্যাম্পাস'র এক পরিত্যক্ত কুড়ে ঘরে । বর্তমানে যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন। নিজের ঘর না থাকায় অন্যের ঘরেই যার জন্ম, তার জন্ম পরবর্তী সকল অনুষ্ঠান অন্যের ঘরে হবে এটাই স্বাভাবিক । সঙ্গত কারনে প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রথম ইন্টারভিউটি অনুষ্ঠিত হয় বর্তমানের বিশাল ক্যাম্পাসে অবস্থিত বামনী হাই স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জনাব সফিউল্যাহ বিএসসি এর অফিস কক্ষে ।
চাকুরির পরীক্ষা বললে এটা ছিল আমার দ্বিতীয় ভাইভা পরীক্ষা । তার কিছুদিন আগে ১৬ তম বিসিএস এর মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশন ভবনে । আমার ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন পিএসসি’র চেয়ারম্যান জনাব এসএমএ ফায়েজ যিঁনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন । ঐ বোর্ডের সদস্য ছিলেন চেয়ারম্যান সহ পাঁচজন । চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য কারও নামই জানা সম্ভব হয়নি । তবে অন্যান্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে আগে পরে আলাপকালে জেনেছি একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক, একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান, অপর দু’জনের পরিচয় জানতে পারিনি । সালাম জানিয়ে পরীক্ষার্থীর জন্য রাখা নির্ধারিত চেয়ারটিতে অনুমতি নিয়ে বসলাম। মূলত চাকরির পরীক্ষায় এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ভাইভা। সেসন জটে পড়ে সরকারি চাকরির বয়সও একেবারে শেষ প্রান্তে। ঐ সময় একজন শিক্ষার্থীর প্রতি পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের অন্যতম প্রধান চাওয়াই থাকতো শিক্ষা জীবন শেষে একটা বড় সরকারী চাকুরী পাওয়া। তাই চাকুরিটা পেতেই হবে এমন একটা মানষিক চাপ থাকায় কিছুটা নার্ভাসনেসও কাজ করছিল। চেয়ারম্যান স্যারই প্রথম শুরু করেছিলেন আমার নামের এ এস এম এর পূর্ণ রূপ জানতে চেয়ে। প্রাসঙ্গিক দু'চারটি কথার পরই সাবজেক্ট এর দক্ষতা যাচাই হলো। এটাতে তেমন খারাপ করিনি বলেই মনে হয়েছে। ধরাটা খেয়েছি ইংরেজি দক্ষতা যাচাই এর অংশে। এইচএসসি পর্যন্ত আমাদের সময় অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই ইংরেজি দক্ষতা ছিল Prose ও Poetry থেকে সিলেক্টেড কয়েকটি Broad and Short Question এর Answer, কয়েকটি সিলেক্টেড Explanation, কয়েকটি Summary আর The Cow, Student Life, Aim in Life, Rainy Season এর মত কয়েকটি নির্ধারিত Eassy আর Paragraph মুখস্থ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেকারণে সীমিত সংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে Conversational English প্রয়োগে দক্ষতা প্রদর্শন করা ছিল কঠিন ব্যাপার।
প্রথম ইংরেজি প্রশ্নটাই বুঝতে পারিনি। নার্ভাস ফিল করছিলাম। চেয়ারম্যান স্যার একই প্রশ্ন বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর দিতে পেরেছি। এবার তাঁরা প্রশ্নের ধরণও পাল্টালেন। বোর্ডের সামনে প্রায় পনের মিনিট ধরে যাচাই বাছাই এর সময় যেখানে আটকে যাচ্ছিলাম সেখানেই যুবরাজের মত চেহারার অধিকারী ফায়েজ স্যার আপনজনের মতোই কৌশলে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমিও আমার পেশাগত জীবনে স্থানীয় কয়েকটি নন গভার্নমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় শুরুতে যাদের পারফরমেন্স মোটামুটি ভালো লেগেছে তাদেরকে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছি। এক্ষেত্রে ফায়েজ স্যার এর আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ভূমিকার কথা সবসময় মনে পড়তো।
যাই হোক, ভাইভা পরবর্তী সময়ে মনে কিছুটা আত্মবিশ্বাস উঁকি ঝুঁকি মারছিল। তখন ইন্টারনেট ভিত্তিক মিডিয়া না থাকায় রেজাল্ট জানা যেত পিএসসির নোটিশ বোর্ড আর পরের দিনের জাতীয় পত্রিকায় । বিটিভি'র খবরে শুধু ফলাফল প্রকাশ হয়েছে বলে জানা যেত। বিটিভি'র খবর শুনেই পিএসসিতে যাই রেজাল্ট দেখতে। বর্তমানে সাতকানিয়া সরকারি কলেজে কর্মরত ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব জসীম উদ্দিন আহমেদ সহ একসঙ্গে পিএসসিতে প্রবেশ করি নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট দেখতে। জসীম ভাই সফল হলেও ভাগ্য আমার সহায় হয়নি।
১৬ তম বিসিএস ছিল সরকারি কলেজের শিক্ষক নিয়োগের স্পেশাল বিসিএস। প্রিলিমিনারী টেস্ট, সাইকোলজিক্যাল টেস্ট কোয়ালিফাই করে তবেই ভাইভা । ছাত্র জীবনে লেখাপড়ার প্রতি আমার তেমন সিরিয়াসনেস না থাকলেও ১৪শ বিসিএস এ কোয়ালিফাই করা প্রতিবেশী মেধাবী সিনিয়র ভাই প্রফেসর আবু জাফর মোহাম্মদ সাদেক এবং ১৩ তম বিসিএস এ কোয়ালিফাই করা মেধাবী সহপাঠী প্রফেসর আবু মোহাম্মদ রহিম উল্লাহ এর সফলতা আমাকে বিসিএস এর প্রস্তুতিতে অনেকটা উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। অল্প কয়েক মাস রাত দিন পরিশ্রম করেছি কিন্তু খুব দ্রুতই টের পেয়েছি -একাডেমিক শিক্ষা জীবনের এত বড় ঘাটতি এত সময়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। আমার ব্যর্থতার প্রধানতম কারণ ছিল শিক্ষা জীবন শেষ করে তারপর চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া । এটা সম্পূর্ণ ভুল কনসেপ্ট। বিসিএস ও অন্য সকল ক্যারিয়ারের পরীক্ষার জন্য একটি আউটলাইন তৈরি করে নিতে হয় এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতে হয় স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা শুরুর প্রথম দিক থেকেই।
বামনী কলেজের সেদিনের শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা পরীক্ষাটা আমার কাছে ছিল ছাত্র জীবনের সাময়িক পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতির মতই সাধারণ একটা বিষয় । বোর্ডের মুখোমুখি হওয়ার ডাক পড়লে যখন কক্ষের ভিতরে ঢুকি তখন ব্যাপারটা আর মোটেই সাধারণ ব্যাপার বলে মনে হলোনা । একি ! এত লোক ! এলাহি কান্ড ব্যাপার ! প্রায় জন বিশেক বা তার কিছু বেশি লোকতো হবেই । কয়েক মুহুর্ত্বের জন্য ক্ষানিকটা ভীত হয়েছিলাম । অবশ্য দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাইভার জন্য মানষিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম । ঐ মজলিশের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি যার মুখভরা পাকা দাঁড়ি, কপালে অভিজ্ঞতার অনেকগুলি ভাঁজ, ইনকরা পরিপাটি পোশাক, মাথায় অল্প পরিমান কাঁচা-পাকা চুল, চেহারায় পান্ডিত্যের ভাব, আমার স্পষ্ট মনে আছে তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি বিনম্রভাবে অনুমতি চাইলাম-বসতে পারি স্যার ? তিঁনিই বললেন হ্যাঁ বসুন । কন্ঠের আওয়াজ শুনে মনে হলো ক্লান্তি আছে কিন্ত দেখে বুঝার উপায় নেই ।

সবার দিকে একনজর তাকিয়ে আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সরকারি মুজিব কলেজের বাংলা বিষয়ের অধ্যাপক জনাব শাহজাহান স্যার, কোম্পানীগঞ্জের এযাবত কালের সবচেয়ে স্বনামধন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মুন্সি আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুজিব কলেজের অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক সফিউল্যাহ বিএসসি, নুর আহম্মদ চৌধুরী ও আলী আহম্মদ চেয়ারম্যান ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারিনি । ঐ বোর্ডে সাবজেক্ট এক্সপার্টদের মধ্যে শাহজাহান স্যারই ছিলেন সবচেয়ে সিনিয়র। আমি যাঁর অনুমতি নিয়ে বসেছিলাম শাহজাহান স্যার তাঁকেই বললেন স্যার আপনিই শুরু করুন । শাহজাহান স্যারের বলার স্টাইল দেখে আমার বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয়নি যে তিঁনি শাহজাহান স্যারের চাইতেও বড় কিছু ।

ইত্তেফাক পত্রিকার বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, পৌরনীতি,সমাজ কল্যাণ, ইসলাম শিক্ষা, ইসলামের ইতিহাস, ব্যবস্থাপনা, হিসাববিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান এ ১২ টি বিষয়ের যেহেতু ইন্টারভিউ কল করা হয়েছে সেহেতু উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ১২ জন হবেন সাবজেক্ট এক্সপার্ট । আমার সাবজেক্ট এক্সপার্ট ছিলেন জনাব ছদরুদ্দিন আহমদ Dr-Sadruddin Ahmed তাছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মুজিব কলেজের অধ্যক্ষ, সফিউল্যাহ বিএসসি, নুর আহম্মদ চৌধুরী ও আলী আহম্মদ চেয়ারম্যান সহ আরও ৪/৫ জন । সব মিলিয়ে বিশ জনেরও অধিক। এতবড় ভাইভা বোর্ড ফেস করতে গিয়ে যে কারও হাটু কাঁপাটা স্বাভাবিক । যথারীতি ভাইভা শেষে বের হলাম । কেউ একজন বললেন দুপুরে সবার জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা আছে তাই কেউ যেন খাওয়া ছাড়া চলে না যাই । নূর আহম্মদ চেীধুরীর বাড়ীতে খাওয়ার সময় পরিচিত হয়েই মূলত বুঝতে পারি ভাইভা বোর্ডে যাদের চিনতে পারিনি তাঁদের মধ্যে ছিলেন বামনী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী, সর্বজনাব মৌলভী জামাল উদ্দিন, আবু তাহের কোম্পানী, হাজী তোফাজ্জল হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন লাতু ও আরও কয়েকজন । বিগত ঊনত্রিশ বছরে স্থানীয় আরো বহু মানুষকে জেনেছি যাঁদের কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
নূর আহম্মদ চৌধুরীর রাইচ মিলের মাঠে ছোট প্যান্ডেল বানানো হয়েছিল মেহমানদের খাওয়ানোর জন্য। ভিআইপিগণ আগে খাবেন এটাই স্বাভাবিক। খেতে হলে কমপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। একা একা অপেক্ষা করতেও ভালো লাগছেনা। কিছুটা ভীড় দেখে দেরি হবে ভেবে কৌশলে বিদায় হবার জন্যে যখন উদ্যত ঠিক তখনই পাশে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন এক প্রার্থীর দিকে নজর পড়লো। এগিয়ে হাত বাড়িয়ে পরিচিত হলাম। জানলাম তিনি ফারুখ হোসেন মোঃ নিজামী Faruk Hossain বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের প্রার্থী। সামান্য কথোপকথনে তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলাম। দু'জন এক সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় সেই গাছের নিচেই কাটালাম। আগে যারা খেয়েছেন তাদের খাওয়া পরবর্তী তৃপ্তিকর আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম ভালো আয়োজন করা হয়েছে। বামনী এলাকার আতিথেয়তার সুনাম আমি ছোটবেলা থেকেই জানতাম। চৌধুরীর রাইচ মিলের ম্যানেজার আমাদের দুজনকে খেতে ডাকলেন। আয়োজকের অনুমানের চেয়ে মেহমান বেশি হবার কারণে আমাদের শেষের কয়জনকে শুধু লাউ আর পাতলা কলাই ডাল দিয়েই খেতে হয়েছিল। আসলে রিজিকের ফয়সালাতো আসমানে হয় জমিনে নয়। দু'জন এর ধ্যান ধারণা যথেষ্ট মিল থাকায় এই সহকর্মী ফারুক ভাইয়ের সাথেই সবচেয়ে ভালো কেটেছে পেশাগত জীবনের আটাশটি বছর। ২০২৩ এর ডিসেম্বরে ফারুক ভাই আর আরেক প্রিয় সহকর্মী কাশেম মোঃ কবির উদ্দিন ভাই সুদীর্ঘ আটাশ বছরের পেশাগত জীবন শেষ করে অন্য সব সাধারণ দিনের মতোই একরকম নিরবেই অবসর জীবনে চলে যান কিন্তু বামনী এলাকার অনেকেই হয়তো বিষয়টি জানেন না। বেঁচে থাকলে আগামী বছর ৩১ ডিসেম্বর বুধবার আমাকেও বিদায় নিতে হবে। তবে সেটা সরবে নাকি নিরবে আল্লাহই ভালো জানেন।
ভাইভা বোর্ডে যাঁর অনুমতি প্রার্থনা করে বসেছিলাম তিঁনি আর কেউ নন, তিঁনি হলেন বামনী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম অধ্যক্ষ অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, সর্বজন শ্রদ্ধেয়, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অনেক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, ভীষন মজার মানুষ জনাব এম এ বারী । তিঁনি আজ আর বেঁচে নেই । আজ থেকে বাইশ বছর আগে ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী তিঁনি পরলোক গমন করেন । ৩১ আগস্ট ১৯৯৫ আমি বামনী কলেজে আনুষ্ঠানিক যোগদান করি । আমাদের বসার জায়গা বলতে যা ছিল তা হলো বামনী হাই স্কুলের পুরোনো জায়গায় অবস্থিত মাটির ফ্লোর, চারদিকে বেড়া আর টিনের ছাউনিতে তৈরি পরিত্যক্ত ঘরের দেড়শ থেকে দু’শ বর্গফুটের একটি কক্ষ । কক্ষটি ছিল অধ্যক্ষের কার্যালয় কাম শিক্ষক মিলনায়তন কাম একাউন্টস অফিস । অর্থাৎ একের ভিতর তিন । সে কক্ষে ছিল অধ্যক্ষের জন্য একটি পুরোণো টেবিল ও একটি চেয়ার, একপাশে একটি স্টীলের আলমারি, শিক্ষকদের জন্য পুরাতন লক্কর ঝক্কর হাতাবিহীন ৮/১০ টা কাঠের চেয়ার আর হিসাব রক্ষকের জন্য ছোট্র একটি পুরোনো টেবিল । কলেজের শুরুতে আর্থিক এত দৈন্য দশার মধ্যেও প্রতিদিন এক কাপ চা আর একটি খেজুরী ছিল প্রত্যেক শিক্ষক কর্মচারির ফিসিয়ালী রুটিন আপ্যায়ন। খেজুরি হলো চিনি মিশ্রিত ময়দার খামির দিয়ে তৈরি তেলে ভাজা খেজুর আকৃতির এক ধরণের পিঠা। বামনীতে সেটা এখনও পাওয়া যায়। কয়েক মাস আগে হঠাৎ মনে পড়ায় আমরা তিন সহকর্মী বামনী বাজারের আরজু হোটেলে খেতে গিয়েছিলাম।
যাইহোক, আধুনিক যুগে আমরা যেটাকে ওয়াশ রুম বলি তখন ওয়াশ রুমের বিকল্প ছিল এ ঘরটির উত্তর পাশে খোলা আকাশের নিচে কয়েকটি গাছ গাছালির আড়ালে পরিত্যক্ত ২/১ টি ওয়াল ঘেরা …….খানা । সে জায়গাটাকে আমরা সুন্দরের জন্য বাগান বাড়ি বলতাম।
বারী স্যারের সাথে যখন কর্ম জীবন শুরু করি তখন তাঁর বয়স ৬২ বছরের মত । আমাদের অনেকের বয়স ছিল তখন আনুমানিক ২৭ থেকে ৩০ এর মধ্যে । আমরা রুমে ঢুকতেই সালাম দিয়ে ঢুকতাম । আমার স্পষ্ট মনে আছে এ বয়সেও স্যার কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডসেক করতেন তারপর আমাদেরকে বসতে বলে নিজে বসতেন । আমাদের মধ্যে যারা এ ভদ্রতাটুকু শিখেছে তা এম এ বারী স্যারের কাছ থেকেই । বারী স্যার বস হয়েও বসের মত ব্যবহার করতেননা। তিঁনি আচরণ করতেন নেতার মত। ’Be a Leader, Not a Boss’ এ কথাটি জীবনে বহুবার পড়েছি এবং শুনেছি কিন্ত বারী স্যারকে বাস্তবে এমনটা দেখেছি। সেজন্য আমরা অনেকেই আগ্রহের সঙ্গে তাঁর নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকতাম। বারী স্যার ছিলেন পিতার মত দায়িত্বশীল, নেতার মত নির্দেশ দাতা, বন্ধুর মত খোলামেলা স্বভাবের।

লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরা গ্রামে ১৯৩৫ সালে জনাব এম এ বারীর জন্ম । ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অনার্স ও একই বিষয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে এম এ পাশ করেন । পুরো কর্মজীবনই ছিলেন শিক্ষকতার সঙ্গে । জীবনে প্রায় ১০ টি কলেজে অধ্যাপনা ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের যে অভিজ্ঞতা তিঁনি অর্জন করেছেন তা অন্যের জন্য ছিল অনুকরনীয়, অনুসরনীয় ও শিক্ষনীয় । ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক হলেও প্রায় সকল বিষয়েই তাঁর দখল ছিল ।
১৯৯৪ সালের সে জীর্নশীর্ন কুড়েঘর থেকে বামনী কলেজ আজ অট্রালিকায় । বামনী কলেজের এমন সুদিন দেখলে দুর্দিনের কান্ডারী বারী স্যার নিশ্চয়ই খুশি হতেন । আজ বামনী কলেজের অনেক কিছু আছে কিন্ত নেই বারী স্যার, আরও নেই বামনী কলেজের দুর্দিনের আরও কয়েক বন্ধু মরহুম সফিউল্লাহ বিএসসি, মরহুম নূর আহম্মদ চৌধুরী, মরহুম আলী আহম্মদ চেয়ারম্যান, মরহুম মৌলভী জামাল উদ্দিন, মরহুম আবু তাহের কোম্পানী, প্রমূখ।
বামনী এলাকার প্রবাসী আমেরিকানদের আর্থিক অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয় এ কলেজটি। বাবু রমেশ চন্দ্র মজুমদার ও জনাব হাবিব উল্যাহ চৌধুরী প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সর্বজনাব প্রফেসর এ এন এম বিল্লাহ, কামরুজ্জামান মিয়া, মৌলভী জয়নাল,আবু নওশাদ, ইকবাল বাহার চৌধুরী সহ আরও অনেক প্রবাসীর নাম শুনা যেত কলেজ প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত আলোচনা আসলেই।

বারী স্যারের হাত ধরে শুরু হওয়া সময়কাল থেকে টানা ঊনত্রিশ বছর এ পেশায় আছি। কলেজের শুরুতে শিক্ষার্থীর কোয়ানটিটি ছিল কম কিন্ত কোয়ালিটি ছিল বেশি। এখন কোয়ানটিটি বেড়েছে কিন্ত ধ্বস নেমেছে কোয়ালিটিতে। ব্যবস্থাপনার ছাত্র হিসেবে সব কিছুতে সবার আগে ব্যবস্থাপনাকে দেখার অভ্যাস (কারও কারও মতে বধ অভ্যাস) আমার শিক্ষা জীবন থেকেই। ২৮-২৯ বছরের পেশাগত জীবনে বহু রুপের ব্যবস্থাপনা দেখেছি। যেটিকে আমার শিক্ষার সঙ্গে মিলাতে পেরেছি সেটিকে সমর্থন করেছি আর যেটি সমর্থনযোগ্য নয় সেটি ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেনে নিয়েছি।

কি পাওয়ার কথা ছিল? কি পেয়েছি? যা পেয়েছি তা কিভাবে পেয়েছি? যা পাইনি তা কেন পাইনি? এসব ছোট ছোট প্রশ্নের বড় বড় উত্তর আছে। বৈচিত্র না থাকলেও ২৮/২৯ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা নেহায়েত কম নয়। এ সময়ের ময়না তদন্ত করলে তার রিপোর্ট দিয়ে রীতিমত একটি ছোটখাটো উপন্যাস লেখা যাবে।

দুঃখ প্রকাশঃ

প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের অবতারনা করতে গিয়ে লেখাটির অবয়ব বৃদ্ধি হয়েছে যা হয়তো সম্মানিত পাঠককের বিরক্তির কারণ হতে পারে। আশাকরি সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

শেষকথাঃ

মরহুম এম এ বারী ছিলেন আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, বিনয়ী, সদালাপী, বন্ধুভাবাপন্ন, সর্বজন শ্রদ্ধেয়, ধর্মপরায়ন ও একজন মজার মানুষ । এমন একজন গুনীজনের সান্নিধ্যে অল্প ক’টা দিন থাকতে পেরে নিজেকে অত্যন্ত ধন্য মনে করছি। আজ ২৩ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মরহুম এম এ বারী স্যারের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি । একই সঙ্গে বামনী কলেজ পরিবারের যেসব সদস্য পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তাঁদের কর্মের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি । প্রার্থনা করছি আল্লাহ যেন তাঁদের সকলকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন । আমীন।

[ লেখকঃ এ এস এম কামাল উদ্দিন ]

বি. দ্র. - লেখাটি ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ আমার ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য লেখা হয়েছিল। আরও অধিক পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে লেখাটি আমার এ ব্যক্তিগত ব্লগেও পোস্ট করে রাখা হলো।