স্মৃতিপটে
আহসান মঞ্জিল
---সাবরিনা তাসনিম শশী ।।
গত
তিন চারদিন যাবত আব্বু জিঞ্জেস করছেন আহসান মঞ্জিল জাদুঘর পরিদর্শনের লেখাটি শেষ করছিনা
কেন ? বললাম অনেকগুলো তথ্য মনে করতে পারছিনা তাই । আব্বু বললেন সমস্যা নেই আমি এডিট
করে দেব, তুমি যা মনে আছে লিখে ফেল । তাই এ ভ্রমন কাহিনীটিও আব্বুর সহায়তায় সম্পন্ন
করলাম।
আগেরদিন শাহবাগে
অবস্থিত জাতীয় জাদুঘর দেখা হলো । পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ যাওয়ার
কথা আহসান মঞ্জিল জাদুঘর দেখতে । সিদ্ধান্ত হয়েছিল সকাল ১০ টা থেকে ১১ টার মধ্যে রওয়ানা
হবো । সকাল আটটার দিকে আব্বু জানালেন এ বেলা যাওয়া হবেনা, যেতে হবে বিকেল বেলা । মনটা
খারাপ হলো । কোনটাই পরিকল্পনা অনুসারে হচ্ছেনা ।আব্বুর কাছে কারন জানতে চাইলে আব্বু
প্রথমেই বললেন-মনে রাখবে শহরে পরিকল্পনা মাফিক সব কিছু করা যায়না । বললেন আজ শারদীয়
দুর্গা পুজার বিজয়া দশমী । এ দিনই দেবী বিসর্জন হয় । আহসান মঞ্জিলের অবস্থান পুরোনো
ঢাকায় । পুরোনো ঢাকার রাস্তাগুলো অনেক সংকীর্ন । প্রায় সারাক্ষনই যানযট লেগে থাকে ।পুরোনো
ঢাকায় অধিকাংশ হিন্দু পরিবার বসবাস করায় এখানে পুজা মন্ডপ বেশি । এ এলাকার সব দেবী
মুর্তি বিসর্জন হয় বুড়িগঙ্গায় । আর আহসান মঞ্জিলের অবস্থানও পুরোনো ঢাকায় বুড়িগঙ্গার
তীরে ।আব্বুর ধারনা ছিল সকাল বেলা এসব কারনে ভয়াবহ যানযট থাকবে তাই বিকেল বেলা যাওয়ার
সিদ্ধান্ত ।
কী আর করা এটা ওটা করে সময় অতিক্রম
করার চেষ্টা । আব্বুর কাছে জানতে চাইলাম আহসান মঞ্জিল যাওয়ার পথে দেখার মত আর কোন ঐতিহাসিক
কিছু আছে কিনা ? আব্বু জানালেন আছে যেমন- জর্জ কোর্ট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাহাদুরশাহ
পার্ক । আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম বাহাদুরশাহ পার্ক কি রমনা পার্কের মত ? আব্বু হেঁসে
উত্তর দিলেন- তোমার নানু বাড়ির উঠানের চাইতে কিছুটা বড় হতে পারে ।কথাটা শুনে মজা পেলাম
কিন্ত আশ্চর্য হলাম ।তাহলে এটা এত বিখ্যাত কেন ? আব্বু বললেন এটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
আছে ।প্রথমে এটার নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক । ভিক্টোরিয়া ছিলেন ইংল্যান্ডের তৎকালীন
রাণী যিঁনি মহরাণী ভিক্টোরিয়া হিসেবে পরিচিত ।পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ’র
নামানুসারে ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক ।পার্কটির
অবস্থান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের কাছাকাছি ।
বিকেল তিনটায় রওয়ানা হলাম । আগের
দিনের মতই রওয়ানার পূর্বে আব্বু বলে দিলেন-ভ্রমনটা ভালোভাবে উপভোগ করতে । অবশ্যই এ
ভ্রমন নিয়েও একটা ট্রাভেল স্টোরি লিখতে হবে । আব্বু বরাবরের মতই আমাদেরকে এটা ওটা চিনাতে
চেষ্টা করলেন ।বললেন একদিন পড়ার সময় তুমি আমাকে শহীদ নূর হোসেন চত্বর সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করেছিলেনা ? সামনের এটাই নূর হোসেন চত্বর ।পশ্চিম পাশের বিশাল ভবনটি হলো সচিবালয়, আর
পূর্ব পাশেরটা দেশের প্রধান পোস্ট অফিস জিপিও । জিপিওর পূর্বপাশে জাতীয় মসজিদ বায়তুল
মোকাররম আর তার পূর্বপাশে জাতীয় স্টেডিয়াম । আরও আরও কত কি চিনানোর চেষ্টা করেছেন তবে
এত অল্প সময়ে এত কিছু মনে রাখা কঠিন ।
ধীরে ধীরে সমনে এগিয়ে চলছি ।
আব্বু বললেন সামনে যানযটের আলামত ।দু’ঘন্টায়ও পৌঁছতে পারব কিনা সন্দেহ ।আবারও মন খারাপ
হলো । আম্মু, আব্বু আর আমরা তিন বোন যাচ্ছি ।আব্বু বললেন বিরক্ত বোধ করিওনা । ঢাকা
সিটিতে বাস করতে হলে এগুলিকে স্বাভাবিক ভেবে মেনে নিতে হবে । তবে যানযটের মধ্যে পড়লে
ব্যাগ, মোবাইল, অলংকার ইত্যাদির প্রতি সতর্ক থাকতে হয়, কারন এসব জায়গায় ছিনতাইকারীরা
এগুলি টান মেরে দৌড়ে পালাতে পারে । আমাদের বিরক্তির ভাব কাটাতে আব্বু অন্য প্রসঙ্গ
তুললেন ।
প্রায় এক ঘন্টার যানযট অতিক্রম করে আব্বুই দেখালেন ডানদিকে
জর্জকোর্ট, সামনে একটু বাঁদিকে বাহাদুরশাহ পার্ক, তার একটু সামনে ডানদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
। তারপর আরও কিছু যানযট অতিক্রম করে কাংখিত ঐতিহাসিক আহসান মঞ্জিলে পৌঁছলাম । গেটেই
টিকেট কাউন্টার । বড়দের টিকেটের মূল্য মাথাপিছু ২০ টাকা আর শিশুদের টিকেটের মূল্য ১০ টাকা । আব্বু টিকেট কিনতে
কাউন্টারে গেলেন ।আমরা যেখানে দাঁড়ালাম সেখান থেকেই কাউন্টারের গায়ে লেখা নির্দেশনা
গুলো পড়ে জানলাম আহসান মঞ্জিল খোলা থাকে শনি- বুধ সকাল ১০.৩০ টা থেকে বিকেল ৫.৩০ টা পর্যন্ত । আর শুক্রবার খোলা থাকে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত । বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটি । সরকারি সব ছুটির দিনে আহসান মঞ্জিল বন্ধ থাকে।
আহসান মঞ্জিল জাদুঘর এরিয়াতে
প্রবেশ করলাম । সুর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে তাই আলো থাকতে থাকতে ছবি তোলার কাজ শেষ
করলাম আব্বুর কথামত ।প্রধান গেট দিয়ে ঢুকেই কারুকাজ খোঁচিত সুন্দর ছোট একটি দালান ।
আব্বু বললেন গ্রামের বাড়িতে ঢুকতে যেরকম কাচারী ঘর থাকে এটা তেমনি নবাব বাড়ির কাচারী
ঘর । নবাবদের কাছে আসা বহিরাগতদের প্রথমে এখানেই অপেক্ষা করতে হতো ।দক্ষিনমুখী কারুকার্য
খোচিত গোলাফী রঙয়ের বিশাল বিশাল দুটি দালান, সামনে বিশাল আঙ্গিনা । দোতলা থেকে আঙ্গিনায়
আসার জন্য বিশাল সিঁড়ি । আঙ্গিনার শেষ প্রান্তেই বুড়িগঙ্গা নদী । আব্বু বললেন বুড়িগঙ্গার
সৌন্দর্য আর আগের মত নেই ।তবে নবাব বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে সময়ের বুড়িগঙ্গার প্রকৃত
সৌন্দর্য কল্পনায় অনেকটাই উপভোগ করা যায় ।
ভিতরে ঢুকে একে একে সবকিছুই দেখা
হলো । ভেতরে রয়েছে বিশাল বিশাল কক্ষ । রয়েছে আসবাবপত্রে সজ্জিত বিশাল ড্রইংরুম যেখানে
প্রায় পঞ্চাশ জনেরও বেশি লোক একসাথে বসতে পারবে । রয়েছে ক্রোকারিজ সামগ্রী দিয়ে সাজানো
বিশাল ডাইনিংরুম যেখানে প্রায় পঞ্চাশ জনেরও বেশি লোক একসাথে খেতে পারবে ।আসবাবপত্রে
সজ্জিত বড় বড় অনেকগুলো বেডরুম, বই ও চেয়ার টেবিল সমৃদ্ধ রিডিংরুম, মিউজিক্যাল সরঞ্জামে
সজ্জিত নাচ-গানের রুম। মূল্যবান জিনিষপত্র সংরক্ষনের লোহার তৈরি আলমারি ও অন্যান্য
লকার সমৃদ্ধ কক্ষ ইত্যাদি ছাড়াও নবাবদের ব্যবহৃত জিনিষপত্রগুলো সুন্দরভাবে সাজানো রয়েছে
আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে । সব কিছুতেই রয়েছে একটা আভিজাত্যের ছাপ, একটা নবাবী ভাবসাব ।
দেখতে দেখতে মন ভরে গেছে, কষ্ট করে আসাটা স্বার্থক হয়েছে । আব্বু বললেন এবার যেতে হবে
। পুরোনো ঢাকা জ্যামে পড়লে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হবে । তাই ইচ্ছা না থাকলেও বিদায়
নেয়ার পালা । একবার পিছনে তাকিয়ে ভালভাবে নবাব বাড়ির রুপটি উপভোগ করে নিলাম ।মনে মনে
বললাম সত্যিই অপরুপ তুমি নবাব বাড়ি । আবার আসতে পারি আর না পারি তুমি স্মৃতিপটে রইবে
আজীবন । বিদায় আহসান মঞ্জিল, গুড বাই নবাব বাড়ি ।