দেখা হলো জাদুঘর

দেখা হলো জাদুঘর                                                         --সাবরিনা তাসনিম শশী ।।

পরের দিনের পরিকল্পনা চুড়ান্ত করেই ঘুমাতে গেলাম ।কিন্ত অত তাড়াতাড়ি ঘুম কি আসে ? কালকের পরিকল্পনা না হয় চুড়ান্ত হলো কিন্ত ঢাকায় থাকা হতে পারে আরও দু’দিন ।গতকালই আব্বু সহ আমাদের ঢাকার বাসায় আসলাম দুর্গা পুজার ছুটিটা সবাই এক সঙ্গে কাটাবো বলে । ঐশি ও গত তিন মাসে তেমন কোথাও যেতে পারেনি কলেজ খোলা থাকার কারনে ।ও ঐশি হলো আমার বড় বোন । ভিকারুন্নিসা নুন কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ।ছোট বেলা থেকে আমরা একে অপরকে নাম ধরে ডাকি ।পরে অবশ্য ঐশিকে আপু ডাকার প্রাকটিস করেছি কয়েকদিন কিন্ত ঐশিই না করল, না শুনতে শুনতে আপু শব্দটা কেমন যেন দূর দূর মনে হয়, বলল আগের মত নাম ধরে ডাকতে । নাম ধরে ডাকাটাই যেন মধুর বন্ধত্বের । থাকগে ওসব কথা, পরের দু’দিনের কথা আগামীদিন চিন্তা করা যাবে ।আর আমরা চিন্তা করেই বা কি লাভ ? আমরাতো এখনও ঢাকার তেমন কিছুই চিনিনা ? আব্বুর পরিকল্পনা মোতাবেক পরেরদিন শুক্রবার সকাল বেলা আহসান মঞ্জিল জাদুঘর আর বিকেল বেলা জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শনের কথা ।আপাতত এটুকু পরিকল্পনা নিয়ে পরের দু’দিনের পরিকল্পনার চিন্তা আব্বুর ঘাঁড়ে চেপে দিয়ে নিদ্রা দেবীর কোলে ঢলে পড়লাম ।

ঘুম ভাঙলো অন্য দিনের চাইতে কিছু আগেই ।কিন্ত ভোর যেন হয়না, অন্ধকার যেন কাটেনা । সূর্য মামা যে রাগ করেছে তা আর বুঝতে বাকী রইলনা ঘড়ি দেখার পর । আকাশের দিকে তাকাতেই দেখি খুব বিষন্ন ভারী হয়ে আছে । মেঘ দেখে মনে হলো এ বরষার শেষ কাঁদাটাই বোধহয় কাঁদবে ।পরিবেশের সঙ্গে আমাদের মনটাও আরও বিষন্ন হলো-ভারী হলো । সারাটা দিন মাটি হবে এই ভেবে মনে মনে রাগ হলাম । কিন্ত প্রকৃতির প্রতি রাগ করা যে অনর্থক, তাই নিয়তিকেই মেনে নিলাম । বেলা প্রায় ১০ টা, সময় যেন কাটেনা । আব্বু সান্তনা দিয়ে বললেন- মন খারাপ করোনা ।এ সময়ের বৃষ্টি বেশিক্ষন স্থায়ী হয়না ।আশাকরি দুপুরের পর আকাশ ভাল হয়ে যাবে । আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে আজ যাব জাতীয় জাদুঘর আর কাল যাব আহসান মঞ্জিল জাদুঘর ।

আকাশের অবস্থা ধীরে ধীরে ভাল হতে লাগল ।পরিকল্পনা অনুযায়ী বিকেল ৩ টায় রওয়ানা হলাম । ‍শুরুতেই আব্বু বলে দিলেন –জার্নিটা ভালভাবে মনে রাখার চেষ্টা করবে কারন এটার উপর একটা ট্রাভেল স্টোরি লিখতে হবে । যাওয়ার পথে আব্বু কিছু কিছু স্থান ও স্থাপনা চিনাতে চেষ্টা করছেন ।আমরাতো এখনও উত্তর-দক্ষিনই ঠিক রাখতে পারিনা ।তবে দিক ঠিক না রাখতে পারলেও কাঁকরাইল মোড়, রমনা পার্ক, হাইকোর্ট এলাকা, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শিশু পার্ক এ জায়গাগুলি আর একবার দেখলে চিনতে অসুবিধা হবেনা ।শুক্রবার তাই রাস্তায় যানযট ছিলনা । ১৫-২০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম । গেটেই টিকেট কাউন্টার । বড়দের টিকেটের মূল্য মাথাপিছু ২০ টাকা আর  ৩ থেকে ১২ বছর বয়সীদের জন্য টিকেটের মূল্য ১০ টাকা । জাদুঘর এরিয়াতে ঢুকলাম ।জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য আব্বু দাঁড়াতে বললেন । আমরা জাদুঘর পেছনে রেখে দাঁড়ালাম ঠিকই, তবে কোন দিকে ফিরে দাঁড়ালাম তা ঠিক করতে পারলামনা ।ছবি তোলা শেষে আব্বু বললেন বাঁ দিকে ওটা হল বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আর তার সামনেই রয়েছে বারডেম হাসপাতাল । ডানদিকে রয়েছে পাবলিক লাইব্রেরী আর পাবলিক লাইব্রেরীর পিছনে বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ।সামনে রয়েছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যা রেসকোর্স ময়দান নামেও পরিচিত । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবুর রহমান এখানেই ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ভাষন দিয়েছিলেন ।

এবার জাদুঘরের ভিতরে প্রবেশের পালা । ঢুকতেই প্রথম দেখলাম বাংলাদেশের বিশাল মানচিত্র ।নিজ জেলার নাম বললে অপারেটর বোতাম টিপে, আর যেখানে লাইটটি জ্বলে ওঠে ওটাই সংশ্লিষ্ট জেলা ।দ্বিতীয় কক্ষে রয়েছে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সুন্দরবন । তারপর একে একে দেখা আর সামনে চলতে থাকা । আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষি ,শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য, গাছ-পালা, ফুল-ফল, পশু-পাখি, গ্রাম বাংলার দৃশ্য এসব অনেক কিছুই রয়েছে জাদুঘরে । কামার, কুমার, জেলে, তাঁতী, কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি পেশার মানুষের জীবনযাত্রা ও ‍তাঁদের উৎপাদিত জিনিষপত্র ইত্যাদি সবই রয়েছে জাদুঘরে ।কী নেই জাদুঘরে ? এক কথায় বলতে গেলে সবই আছে । শিল্পী জয়নুল আবেদীনের আঁকা ছবি নিয়ে রয়েছে জয়নুল গ্যালারী । রবীন্দ্র , নজরুল, বঙ্কিম, শরৎ, মীর মোশাররফ, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের নিয়েও রয়েছে একটি আলাদা গ্যালারী ।দেখতে দেখতে যেন শেষ হয়না । স্বল্প সময়ের মধ্যে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম ভবিষ্যতে আবার আসব, আরও ভালভাবে দেখব এ প্রত্যাশায় ।

জানা হলো বাংলা বর্ষ উপলক্ষে পহেলা বৈশাখ , স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২৬ শে মার্চ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে শিশু ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিনামূল্যে জাদুঘরে প্রবেশের সুযোগ পায় । জাদুঘর সাধারনত শনিবার-বুধ সকাল ১০.৩০ টা থেকে বিকাল ৫.৩০ টা পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে । আর বৃহস্পতিবার জাতীয় যাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধ । 

সময় হাতে থাকলেও হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত তাই বের হতেই হলো । এতক্ষন সময় থাকা হলো, এত কিছু দেখা হলো কিন্তু জাদুঘরের মধ্যে কোন ছবি তোলা হলোনা, কারন যাদুঘরের মধ্যে ছবি তোলা সম্পূর্নরুপে নিষেধ । দু’ ঘন্টারও বেশি সময় থাকা হলো, সব কিছু দেখতে না পারলেও দেখা হলো যাদুঘর । ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চললাম, একবার পেছনে তাকিয়ে মনে মনে বললাম-আবার আসব আবার দেখা হবে। আজকের মত বিদায় জাদুঘর, বাই ।


( বিঃ দ্রঃ আব্বুর কথামত এ ট্রাভেল স্টোরিটি লিখলাম । এর আগে এ ধরনের কিছু লিখা হয়নি । তাই আব্বুর সহযোগিতা নিয়েই লেখাটি সম্পন্ন করেছি।) 

আরও ইভেন্ট দেখতে ক্লিক করুন
               


সাবসক্রাইব করুন

Popular posts from this blog

সরি (Sorry) এর ব্যবহার ও অপব্যবহার

রোহিঙ্গা বনাম নন এমপিও শিক্ষক || প্রসঙ্গ : মানবতা ||