কম-বেশি নব্বই ভাগ পরীক্ষার্থীই
এখন পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার যোগ্যতার জন্য নম্বর পায়না, কষ্ট করে পৃষ্ঠা ভরে কিছু
একটা লেখার জন্য পরীক্ষকের সহানুভূতির পুরস্কার পায় । এমতাবস্থায় আমাদের শিক্ষার ফলাফলকে
গণনা করা গেলেও ওজন করা যাচ্ছেনা ।তুলার বস্তা দেখতে অনেক বড় কিন্ত ওজনে অনেক হালকা
।আমাদের পরীক্ষার্থীদের অধিকাংশ পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখতে অনেক মোটা কিন্ত গুনগত মান
বলতে যা বুঝায় তা নেই প্রায় ৯০ ভাগ উত্তরপত্রেই । তাহলে কী লিখছে অধিকাংশ পরীক্ষার্থী
?
অনেক কিছুইতো লিখছে । পৃষ্ঠার
পর পৃষ্ঠা লিখছে । মূল উত্তরপত্র শেষ করে ৪-৫টা করে অতিরিক্ত উত্তরপত্র লিখছে ।দু’আড়াই
ঘন্টায় কেউ কেউ ৩০-৪০ পৃষ্ঠা লিখছে, কেউবা তারও বেশি লিখছে । যা মনে আসছে তা লিখছে
। যা খুশি তা লিখছে । যা ইচ্ছা তা লিখছে ।এখান থেকে কিছু আর ওখান থেকে কিছু নিয়ে লিখছে
। ডান থেকে কিছু আর বাঁ থেকে কিছু নিয়ে লিখছে । সামনে থেকে কিছু আর পেছন থেকে কিছু
নিয়ে লিখছে । একবার উদ্দীপক’র শেষ থেকে কিছু অংশ নিয়ে উদ্দীপক’র প্রথম অংশ জোড়া দিয়ে
লিখছে । আবার উদ্দীপক’র মাঝখান থেকে কিছু অংশ নিয়ে উদ্দীপক’র প্রথম অংশ জোড়া দিয়ে লিখছে
। একবার এ উদ্দীপক থেকে কিছু আবার ঐ উদ্দীপক থেকে কিছু নিয়ে লিখছে । ইংলিশ অক্ষরে বাংলা
উচ্চারন লিখছে, আর বাংলা অক্ষরে ইংলিশ উচ্চারন লিখছে ।বড় বড় সাইজে দু’তিন বাক্যে ১৫-২০
শব্দ ফাঁক ফাঁক করে লিখে এক একটা পৃষ্ঠা ভরছে আর পৃষ্ঠার সংখ্যা বাড়াচ্ছে ।
সত্যি বলতে গেলে আমাদের
বর্তমান শিক্ষার্থীদের ধৈর্য্য অনেক কম । পরিবেশের নানা প্রভাবে আমাদের বর্তমান জেনারেশনের
অধিকাংশের কর্মক্ষমতাও অনেক কম ।বিশেষ করে যাদের বয়স এখন কৈশোর অতিক্রম করতে যাচ্ছে
এদের ক্ষেত্রেই কথাটি বেশি প্রযোজ্য । এ জেনারেশনটি ভেজাল খাদ্য ও শিক্ষা বাণিজ্যের
কবলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ।বয়স অনুযায়ী শিক্ষায় অতিরিক্ত বিষয়, বিশালকায়
সিলেবাস, অপ্রয়োজনীয় বই ব্যাগে ভরে কাঁধে করে বয়ে বেড়ানো ইত্যাদি অপ্রত্যাশিত পরিশ্রম
তাদেরকে একদিকে করছে খর্বকায় অন্য দিকে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে শিক্ষা ভীতি ও অনীহা
। শিক্ষার চাপ একদিকে শিক্ষার্থীর আনন্দের জগতকে করে দিচ্ছে সংকুচিত, অন্যদিকে বাধ্য
হয়ে বইয়ের পোকা হতে গিয়ে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা হচ্ছে বাধাগ্রস্ত ।তাছাড়া রয়েছে একই
বয়সের শিক্ষার্থীদের একের সাথে অন্যের মেধার তারতম্য ।নগন্য সংখ্যক শিক্ষার্থী এটাকে
কষ্ট করে হজম করতে পারলেও অধিকাংশেরই বদহজম হয়ে যাচ্ছে । এ বয়সে একজন ছেলে বা মেয়ের
কর্ম জীবনে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে বাধ্য হয়ে শিক্ষা জীবনেই থাকতে হচ্ছে ।অন্যেরা পড়ছে
তাই তাকেও সাধ্যমত কিছু না কিছু পড়তে হচ্ছে । অন্যেরা পরীক্ষা দিচ্ছে তাই তাকেও পরীক্ষা
দিতে হচ্ছে । অন্যেরা লিখছে তাই তাকেও কিছু না কিছু লিখতে হচ্ছে । অন্য দিকে সৃজনশীল
পদ্ধতি সম্পর্কে অপ্রিশিক্ষিত শিক্ষকের ভুল ব্যাখ্যা বা শেখানোর ভুল পদ্ধতি শিক্ষার্থীকে
যাচ্ছেতাই শিখতে বা আবোল তাবোল লিখতেও অনুপ্রাণিত করছে ।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে,
‘কইলে মা মারন খায়, না কইলে বাপ হারাম খায়’ । এক ধরনের উভয় সংকট পরিস্থিতি । আমাদের
শিক্ষা ব্যবস্থায়ও অনেক সত্য কথা কইতে পারা এবং সইতে পারা উভয়ই কঠিন । বাস্তব চিত্র
তুলে ধরলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা নিয়ন্ত্রনকারী কর্তৃপক্ষ কম বেশি সকলেরই গায়ে
লাগার কথা । তবুও বলতে হবে, সচেতন মানুষদের এ নিয়ে ভাবতে হবে। নাহলে আমরা মুখে যে গুণগত
শিক্ষার কথা বলছি তা অর্জন হবে সুদূর পরাহত ।
বর্তমান সৃজনশীল শিক্ষা
পদ্ধতিতে প্রাকটিক্যাল যুক্ত বিষয় ব্যতীত অন্য সব বিষয়ে ৭টি উদ্দীপকের বিপরীতে ২৮ টি
প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয় । একজন শিক্ষার্থী সারা বছর কিছু না পড়েই ২৮টি প্রশ্নের উত্তর
লিখতে পারে ।কী পদ্ধতিতে পারে তা এ নিবন্ধের দ্বিতীয় প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে ।কোন
উত্তরই সঠিক হয়নি অথচ ২৮ টি প্রশ্নের উত্তরই লিখেছে, কেউ কেউ ২৫-৩০ পৃষ্ঠা লিখেছে,
কেউবা কৌশল অবলম্বন করে ৩০-৪০পৃষ্ঠাও লিখে পৃষ্ঠার সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে, সেক্ষেত্রে
প্রতিটি উত্তরের জন্য একটি করে জিরো দিয়ে ২৮ টি জিরো দেয়া একজন পরীক্ষকের জন্য একটি
বিরাট কঠিন বিষয় ।তাছাড়া নানা ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার বিড়ম্বনা এড়াতেও পরীক্ষক এমন ঝুঁকি
নিতে চাননা । যে কারনে কম-বেশি নব্বই ভাগ পরীক্ষার্থীই এখন পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার
যোগ্যতার জন্য নম্বর পায়না, কষ্ট করে পৃষ্ঠা ভরে কিছু একটা লেখার জন্য পরীক্ষকের সহানুভূতির
পুরস্কার পায় । এ অবস্থা থেকে পরিত্রানের উপায় বের করতে না পারলে তথাকথিত শিক্ষিত তৈরি
হয়ে দেশ ভরে যাবে, কিন্ত না আসবে দেশের কাজে-না আসবে দশের কাজে ।