ক্যাডার নন-ক্যাডার পদমর্যাদার দ্বন্দ্ব : তিরস্কার নয়, আলোচনাই হোক সমাধান ।

ক্যাডার নন-ক্যাডার পদমর্যাদার দ্বন্দ্ব : তিরস্কার নয়, আলোচনাই হোক সমাধান ।

একটি প্রবাদ আছে, ‘মক্কায়ও চোর আছে, লঙ্কায়ও  ভিখারী আছে ।’ আসলে  ভাল   বা  মন্দ  সব জায়গায়ই  আছে,  পার্থক্য  শুধু সংখ্যায় কম আর বেশি । দু’এক জন  দূর্নীতিবাজ  রাজনৈতিক ব্যক্তির কারনে বলা যাবেনা সব রাজনৈতিক ব্যক্তিই দূর্নীতিবাজ । দু’এক জন অসৎ পুলিশের কারনে বলা যাবেনা সব পুলিশই অসৎ । দু’এক  জন  চরিত্রহীন শিক্ষকের কারনে  বলা  যাবেনা  সব সব শিক্ষকই  চরিত্রহীন । সার্টিফিকেট থাকলে  শিক্ষিত বলা  যায় কিন্ত সুশিক্ষিত হওয়া ভিন্ন জিনিষ ।

ইদানিং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্যাডার-নন ক্যাডার বিষয়টি নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে । চলছে কর্ম বিরতি এমনকি সভা সমাবেশও । ক্যাডার মর্যাদা পাওয়া-দেওয়া নিয়ে যে যার মত করে যুক্তি দিচ্ছেন, তর্ক করছেন । যে কোন বিষয় নিয়ে যুক্তি তর্ক থাকবে এটা যেমন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার । কিন্ত পেশা ভেদে এ যুক্তি তর্ক উপস্থাপনের পদ্ধতির মধ্যেও পার্থক্য থাকবে এটাও তেমনি একটা স্বাভাবিক ব্যাপার । শ্রমজীবি মানুষের যুক্তি তর্ক আর বুদ্ধিজীবি মানুষের যুক্তি তর্ক একই রকম হলে মানুষ চিনবে কীভাবে কে শ্রমজীবি? আর কে বুদ্ধিজীবি? অবশ্যই উপস্থাপন, প্রকাশ ভঙ্গী, শব্দ চয়ন, বডি লেংগুয়েজ, সহনশীলতা ইত্যাদির মাধ্যমে । ইদানিং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্যাডার-নন ক্যাডার বিষয়টি নিয়ে যে বিতর্ক চলছে সেখানেও পেশার সর্বোচ্চ মর্যাদা রক্ষা করেই যুক্তি তর্ক হবে এটাইতো কাম্য হওয়ার কথা । বাঘ আর সিংহের ভাগাভাগির লড়াইয়েও শেষ পর্যন্ত কম্প্রোমাইজ হয় । এক পর্যায়ে উভয় উভয়কে মেনে নেয় । ক্যাডার নন-ক্যাডার দ্বন্দের অবসানও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে হতে পারতো, কাদা ছোড়াছুড়ি করে নয় । কিন্ত দুঃখ জনক ভাবে সত্য যে, আমরা নিজেরা নিজেদেরকে সর্বোচ্চ শিক্ষিত, বিজ্ঞ, মেধাবী দাবি করে সম পেশার অন্যদেরকে হেয় করছি অনেকটা নির্বোধের মতই ।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় ৮০ শতাংশ সেবাই প্রদান করছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । এখানে রয়েছে প্রায় পাঁচ লক্ষ শিক্ষক কর্মচারী । দেশের অধিকাংশ বড় বড় কর্মকর্তাগণ বেশিরভাগই এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাগ্রহনকারী । বিশেষকরে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি (পাস) পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা সেবার সিংহভাগই পূরন করে বেসরকারি শিক্ষা খাত । দেশের পাবলিক বিশ্বদ্যিালয়গুলোতেও উল্লেখযোগ্য হারে মেধার স্বাক্ষর রাখছে এসব নন-গভর্নমেন্ট এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশনের শিক্ষার্থীরা ।আমাদের দেশে সবচাইতে সনামধন্য এবং শিক্ষা ও ফলাফলের দিক থেকে সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষ এখনও নটরডেম কলেজ, ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজ, হলিক্রস স্কুল এন্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ঢাকা কমার্স কলেজ সহ সারা দেশের এরকম আরও অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই বুঝে ।এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেসরকারি হওয়ায় এখানে কোন ক্যাডার শিক্ষক নেই ।মজার বিষয় হলো এসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েই অনেকে ক্যাডার হচ্ছেন ।

উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমান পরীক্ষায় উর্তীর্ন হয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিক্যাল এমনকি ওয়াল্ড র‌্যাঙ্কিং তালিকার শীর্ষের দিকে থাকা ব্র্যাক, নর্থ সাউথ ইত্যাদি ইউনিভারসিটিতে যারা চান্স পাচ্ছে তাদের সংখ্যা জেনে নিলে বুঝা যাবে এক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষার অবদান মোটেই অবজ্ঞা বা অবহেলা করার মত নয় । প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিক্যাল থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পাশ করে বের হচ্ছে । মেধার দিক থেকে এরা প্রায় সম পর্যায়ের ।এসব হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রতি বছর বিসিএস পরীক্ষায় অংশ গ্রহনও করছে ।আমাদের দেশে সরকারি চাকুরির বাজার সীমিত হওয়ায় বিসিএস পরীক্ষায় চুড়ান্তভাবে উর্তীর্ন অল্প সংখ্যক মানুষের চাকুরি হচ্ছে ।অন্যদিকে প্রশ্ন সংক্রান্ত কেলেংকারীর কথা আলোচনায় নাইবা আনলাম কিন্ত কোটা প্রথার ফলে অনেকের যোগ্যতা থাকা সত্বেও ডিসকোয়ালিফাই হয়ে যাচ্ছে একথাতো অস্বীকার করার মত নয়।

যারা প্রায় সম যোগ্যতার হয়েও বিসিএস কোয়ালিফাই করতে পারেননি তাদের অধিকাংশই চলে যায় বেসরকারি শিক্ষা পেশায়, কেউ যায় ব্যাংকিং বা বীমা পেশায়, কেউ সাংবাদিতা পেশায়, কেউ আইন পেশায়, কেউ যায় দেশী বিদেশী কোম্পানীতে, কেউ যায় এনজিও সহ অন্যান্য পেশায় । এসব যায়গায় থাকা অবস্থায় অনেকে ক্যাডার বা নন ক্যাডার জবের জন্য চেষ্টা করে সফলও হয় । কেউ নানা কারনে সংশ্লিষ্ট পেশায়ই থেকে যায় বা কোথাও যাওয়ার চেষ্টাও করেনা । বিগত ৩৫তম বিসিএস এ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উর্তীর্ন হয়েছিল ৫ হাজার ৫১৭ জন । তন্মধ্যে ২ হাজার ১৫৮ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করেছিল পিএসসি ।প্রায় একই যোগ্যতা সম্পন্ন অবশিষ্টদেরকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নন ক্যাডার পোস্টে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছিল । যতদূর জানি তাঁদের মধ্য থেকে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে ।তাহলে প্রায় একই যোগ্যতা থাকার পরও শুধু ক্যাডার পদ পাননি বলে তিঁনি কি ক্যাডারদের কাছে নিগৃহীত হবেন ?

আমাদের দেশে এমন প্রতিষ্ঠানও আছে যে প্রতিষ্ঠানের এখনও এমপিও হয়নি কিন্ত সে প্রতিষ্ঠানে এমন শিক্ষকও আছে যাঁর একাডেমিক রেজাল্ট, শিক্ষকতার দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব, বিনয়, সততা, নিষ্ঠা, পেশার প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি কোন কোন ক্যাডার শিক্ষককেও হার মানাবে । আবার আমাদের দেশে সদ্য বিসিএস কোয়ালিফাই করা আমাদের ছাত্র সমতুল্য এমন মেধাবী শিক্ষকও আছেন যাঁরা শিক্ষকতায় পঁচিশ বছর অতিবাহিত করা আমাদের মত শিক্ষককেও পড়াতে পারবেন ।

পরিশেষে একজন সম্মানিত ক্যাডার শিক্ষকের একটি কর্মের কথা বলেই শেষ করতে চাই ।লেখার শুরুতে দেয়া স্ক্রীনশটটি একজন সম্মানিত ক্যাডার শিক্ষকের ফেসবুক আইডি (তাঁর সম্মান রক্ষার্থে প্রোফাইল ফটো ও নামটি মুছে দিয়ে স্ক্রীনশটটি ব্যবহার করা হলো) । বর্তমানে ক্যাডার নন-ক্যাডার বিতর্কে জড়িয়ে পড়া সম্প্রতি জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষকগণকে হেয় করার উদ্দেশ্যে পোস্টটি দিয়ে মূলত তিঁনি সমগ্র বেসরকারি শিক্ষকগণকেই তিরস্কার করেছেন । তাঁর পোস্টটি দেখেই বুঝা যাচ্ছে তিঁনি শিক্ষক হয়ে জাতিকে কী শিক্ষা দিচ্ছেন ।

প্রতিযোগিতা থাকবে, হার জিত থাকবে, তাই বলে যারা হারবে তাদের অপমান করতে হবে ? দু’টি শক্তিশালী দলের মধ্যে যখন ক্রিকেট খেলা হয়, তাদের এক দল যদি এক রানে জয়লাভ করে তাহলে কি পরাজিত দলকে বলা হবে তারা অযোগ্য ? বিসিএস ক্যাডারের চিন্তা আর রাজনৈতিক ক্যাডারের চিন্তা কি একই রকম হওয়া উচিত ?

একজন ক্যাডার শিক্ষকের নিকট থেকে বেসরকারি শিক্ষকদেরকে তিরস্কারের এমন ভাষা কাম্য নয়। তাই আসুন  ভদ্র ও মার্জিত  ভাষায় এর প্রতিবাদ করি, নিন্দা  জানাই । ক্যাডার-নন ক্যাডার, সরকারি- বেসরকারি, দল-মত  নির্বিশেষে  সকল  স্তরের  শিক্ষক উৎকৃষ্ট ভাষায় এ ধরনের গর্হিত কাজের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করি । শিক্ষকতার মত মহান পেশাকে সকল নিকৃষ্টতার উর্ধ্বে রাখি ।

== এ এস এম কামাল উদ্দিন, বেসরকারি কলেজ শিক্ষক ।

Popular posts from this blog

সরি (Sorry) এর ব্যবহার ও অপব্যবহার

রোহিঙ্গা বনাম নন এমপিও শিক্ষক || প্রসঙ্গ : মানবতা ||