Wednesday, December 13, 2017

অকর্ম’র সকর্ম ভাবনা (পর্ব -২) -পদ্ধতিই যেখানে অসদুপায় অবলম্বনের অনুপ্রেরণা ।

 অকর্ম’র সকর্ম ভাবনা (পর্ব -২)
বিগত পর্বে ‘পরীক্ষার্থীর যোগ্যতার মূল্যায়ন বনাম সহানুভূতির পুরস্কার’ শিরোনামে লেখাটির মূল প্রতিপাদ্য ছিল- কম বেশি নব্বই ভাগ পরীক্ষার্থীই এখন পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার যোগ্যতার জন্য নম্বর পায়না, কষ্ট করে পৃষ্ঠা ভরে কিছু একটা লেখার জন্য পরীক্ষকের সহানুভূতির পুরস্কার পায় ।

এ পর্বেও বাংলায় সে প্রবাদটি দিয়ে শুরু করছি, ‘কইলে মা মারন খায়, না কইলে বাপ হারাম খায়’ ।অর্থাৎ এক ধরনের উভয় সংকট পরিস্থিতি । আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও অনেক সত্য কথা কইতে পারা এবং সইতে পারা উভয়ই কঠিন । বাস্তব চিত্র তুলে ধরলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা নিয়ন্ত্রনকারী কর্তৃপক্ষ কম বেশি সকলেরই গায়ে লাগার কথা ।তবুও কাউকে না কাউকে বলতে হবে, সচেতন মানুষদের এ নিয়ে ভাবতে হবে । নাহলে আমরা মুখে যে গুণগত শিক্ষার কথা বলছি তা অর্জন হবে সুদূর পরাহত ।

আমরা ক্লাসগুলোতে লক্ষ্য করলে দেখি কয়েক ধরনের মেধার শিক্ষার্থী রয়েছে । খুব নগন্য সংখ্যক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা মেধাবী স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য ।স্বল্প সংখ্যক রয়েছে যারা মধ্যম মেধার এবং বড় একটি অংশ রয়েছে সাধারন মেধার । কিন্ত একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় সমবয়সী এসব শিক্ষার্থীর অনেকগুলো কমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দেখলে এদের মধ্যে মেধার এতটা তারতম্য রয়েছে তা মনে হয়না । আমার ব্যক্তিগত ধারনা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মেধাবী । কিন্ত পরিবেশের নানা প্রভাবে এদের মেধার তারতম্য ঘটে থাকে । বিশেষ করে পরিবার, সামাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থা, যথাযথ কাউন্সেলিং ইত্যাদির ভুমিকাই প্রধানতঃ এর জন্য দায়ী ।আবার কিছু আছে প্রাকৃতিকভাবেই কম মেধা সম্পন্ন । তবে কারন যাই হোকনা কেন এগুলি নিরসন করা কোন পক্ষের পক্ষেই অতটা সহজ কাজ নয় ।কিন্ত তাই বলে প্রচেষ্টাতো থেমে থাকতে পারেনা ।

আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যে পদ্ধতি চালু আছে তা সকলের জন্য একই রকম । বিষয়টি আর একটু ব্যাখ্যা করে বলা প্রয়োজন । আমাদের দেশে তিন পদ্ধতির শিক্ষা প্রচলিত রয়েছে যেমন – সাধারন শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষা । সাধারন শিক্ষায় যে সিলেবাস রয়েছে তা সাধারন শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত সকল স্তরের মেধার শিক্ষার্থীর জন্যই প্রযোজ্য । তেমনি মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ।আমরা লক্ষ্য করলে দেখব যে, সকল শিক্ষার্থীর এমন কি সকল অভিভাবকেরও শিক্ষার লক্ষ্য বা চাহিদা এক রকম নয় ।শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে একদল আছে খুবই আত্নবিশ্বাসী এবং উচ্চাকাংখী, যেখানে শিক্ষার্থী বড় মাপের কিছু একটা হতে চায় বা অভিভাবক সন্তানকে বড় মাপের কিছু একটা বানাতে চায় । 

আরেক দল আছে তাদের সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই, নেই সেরকম আত্নবিশ্বাস । এরা সাধারন প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে সাধারন কিছু হতে পারলেও তারা সন্তুষ্ট হয় ।একদল অন্য কোন কাজ নেই তাই পড়তে হবে বলে পড়ে । এরা একেবারেই লক্ষ্যহীনভাবে স্টুডেন্ট লাইফের সঙ্গে থাকে ।এদের সাধারন উদ্দেশ্য থাকে পাশ করে একটা সনদ অর্জন করা । অন্য একদল আছে যাদের উদ্দেশ্য শিক্ষার সঙ্গে লেগে থাকা । পথিমধ্যে বিয়ে বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে স্টুডেন্ট লাইফকে গুডবাই জানিয়ে সংসার বা কর্ম জীবনে চলে যাওয়া ।

শিক্ষার্থীর চাহিদার তারতম্যের কারনে শিক্ষার্থীর পড়া-লেখার পদ্ধতিতেও তারতম্য ঘটে থাকে ।যে যা ফল প্রত্যাশা করে সে অনুযায়ীই পরিশ্রম করে । প্রথম লাইনের স্টুডেন্টরা শ্রম দিয়ে পড়তে চায়, ক্লাস করে শিখতে চায়, নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা দিতে চায়, শ্রম অনুযায়ী সেরা ফল অর্জন করতে চায় ।কিন্ত পরবর্তী লাইনের স্টুডেন্টদের মধ্যে এসব গুণ খুব কমই পরিলক্ষিত হয় ।আগেই বলেছি একই ধারার জন্য প্রণীত সিলেবাস ঐ ধারার সকল শিক্ষার্থীর জন্য প্রযোজ্য । মেধার স্তরগত পার্থক্যের কারনে সকল শিক্ষার্থীর পক্ষে এ সিলেবাসের ভার বইতে পারা সম্ভব হয়ে ওঠেনা ।মেধাবী, মধ্যম মেধাবী ও কম মেধাবী সকল শিক্ষার্থীকে একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে হয় কিন্ত পরীক্ষার জন্য এদের প্রস্ততিতে থাকে বিরাট ব্যবধান ।একই হলে মেধার দিক থেকে সকল স্তরের পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয় বলে সাধারন প্রস্তুতি গ্রহনকারী পরীক্ষার্থীরা নকল করে লেখা বা অন্যের দেখে দেখে লেখার প্রতি বেশি আগ্রহী হয় ।এক পর্যায়ে পরিবেশের প্রভাবে ভাল মন্দ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় ।

ইদানিং আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থাকে নকল পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে ।নকল যেন পরীক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিনত হয়ে যাচ্ছে ।যত চেষ্টাই করছি নকলকে কোনভাবেই যেন আমরা রুখতে পারছিনা । আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গেই যেন নকল জড়িয়ে আছে আঠার মত ।চার জনকে আলাদা অবজেক্টিভ প্রশ্নের সেট বিলি করলেও কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে চার জনের একই সেট হয়ে যাচ্ছে যেন জাদুর মত ।এভাবে নকলের সূত্রপাত হচ্ছে পরীক্ষা শুরুর প্রথম মিনিট থেকেই যা বিভিন্ন কৌশলে অব্যাহত থাকে পরীক্ষার শেষ মিনিট পর্যন্ত ।

পরীক্ষার্থীর তুলনায় হলে কর্তব্যরত পর্যবেক্ষকের সংখ্যার অপ্রতুলতা এবং পারিপার্শ্বিক নানা কারনে হল পর্যবেক্ষকের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া রিতীমত এক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ।ফলে দিন দিন পরীক্ষার্থীর নকল প্রবনতা বৃদ্ধি ও শিক্ষকের নিয়ন্ত্রন বিমুখতার কারনে কিছু অসচেতন ও অসাধু অভিভাবকও এ নকলের মহোৎসবে শরীক হয়ে যাচ্ছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বুঝে অথবা না বুঝেই ।এ অবস্থা থেকে পরিত্রানের উপায় খুজতে হবে সকল সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিককে ।নইলে এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম নিমজ্জিত হবে এক নকলের মহা সমূদ্রে । এখনই প্রতিকার করতে না পারলে পরে অরাজকতার মহাসাগর থেকে প্রজন্মকে উদ্ধারের চেষ্টা হবে কলা গাছের ভেলায় চড়ে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার মত বৃথা চেষ্টার শামিল । 

== লেখকঃ এ এস এম কামাল উদ্দিন (সহকারী অধ্যাপক)

রিলেটেড পোস্টসমূহ-  

Featured post

অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী স্মরণে।

অধ্যক্ষ এম এ বারী ছবিটি স্যারের জৈষ্ঠ পুত্র জনাব সাজ্জাদুল বারী ’র নিকট থেকে সংগৃহীত।  আমার প্রথম বস অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী। আজ থেকে ঊনত্রিশ...