![]() |
Product Vs. Service-educationpointbd.blogspot.com |
বিগত
পর্বে–‘পদ্ধতিই যেখানে অসদুপায় অবলম্বনের অনুপ্রেরণা’ শিরোনামে নিবন্ধটিতে আমাদের
শিক্ষা ব্যবস্থায় সর্বগ্রাসী নকল প্রবনতার বিষয়ে শিক্ষা পদ্ধতির কিছু ত্রুটি সম্পর্কে
সাধারনভাবে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি ।
নকল
প্রবনতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অতীতেও ছিল, এখনও আছে ।দু’য়ের মধ্যে পার্থক্য হলো এখন
নকলের চরিত্র নগ্নতায় পরিপূর্ন।
এখন
নকলকারী শিক্ষার্থী নকলকে অধিকার হিসেবে ব্যবহার করতে চায় । এখন নকলকারী শিক্ষার্থী
নকলের জন্য শিক্ষকের শাসন বারন মানতে রাজি নয় ।আগে লুকিয়ে করত এখন প্রকাশ্যে করতে চায়
।আগে নকলে ধরা পড়লে অনুতপ্ত হতো, শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাইতো, আর করবেনা বলে প্রতিশ্রুতি
দিত, এখন ধরা পড়লে হাসি তামাশায় সেটাকে উপভোগ করতে চায় ।
একটি
বিষয় বিশেষভাবে লক্ষনীয় যে, নকল প্রবনতা শহরের শিক্ষার্থীদের চাইতে গ্রামের শিক্ষার্থীদের
মধ্যেই বেশি। আবার গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতন ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে
নকল প্রবনতা অনেকটা কম ।শহরের এবং গ্রামের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নকল প্রবনতা
কম থাকার প্রধানতম কারন পিতা মাতার সচেতনতা এবং যথাযথ কাউন্সেলিং । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
দেখা যায়, নকলের প্রতি আগ্রহী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকগণ অসেচেতন । তাঁরা সন্তানের শিক্ষার
পিছনে নিজে কোন সময় ব্যয় করেননা ।এদের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অভিভাবক শ্রেণি আছেন
যাঁরা সন্তানের শিক্ষার পিছনে প্রয়োজনীয় ব্যয় প্রদানে মোটেই কার্পন্য করেননা কিন্ত,
সন্তানের লেখাপড়ার দায়িত্ব ছেড়ে দেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও প্রাইভেট টিউটরের
উপর ।শহরের শিক্ষার্থীরা পিতা মাতা বা অভিভাবকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ তত্বাবধানে যতটা
সময় পড়ালেখার পিছনে ব্যয় করে, গ্রামের শিক্ষার্থীরা ততটা বা তার চেয়েও বেশি সময় পিতা
মাতা বা অভিভাবকের তত্বাধানের বাইরে পড়ালেখা ছাড়া অন্য কাজে বেশি ব্যয় করে ।
বর্তমানে
আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে বিভিন্ন শ্রেণির জন্য প্রণীত সিলেবাসের বহর অনেক বড় ।শুধু
সিলেবাস কেন শিক্ষার্থীর বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী সাবজেক্টের সংখ্যাও অনেক বেশি ।অনুমোদিত
টেক্সট বইয়ের ভাষার কাঠিন্য বেশি হওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পক্ষেই নিজে থেকে সমস্যা
সমাধান সম্ভবপর হয়ে উঠছেনা ।সিলেবাসের ব্যাপকতা, টেক্সট বইয়ের ভাষার কাঠিন্য ইত্যাদি
কারনে একজন শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট শিক্ষা বর্ষের মধ্যে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুধু
লেখাপড়া করা ছাড়া প্রয়োজনীয় খেলাধুলা বা আর কিছুই করার সময় থাকেনা । শহরের পরিবেশে
প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাসের সময় ছাড়া শিক্ষার্থীদের বাইরে থাকার সুযোগ কম থাকায় শিক্ষার্থীরা
বাধ্য হয়েই পড়ালেখায় সময় ব্যয় করতে পারে ।অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে
বিষয়টি অনেকটাই বিপরীত অবস্থা ।
শিক্ষার্থীর
বয়স ও মেধার সাথে সমন্বয়হীন শিক্ষা কারিকুলাম, সাবজেক্টের আধিক্য, সিলেবাসের ব্যাপকতা,
শিক্ষাবর্ষের জন্য বরাদ্দকৃত সময়, পরিবেশ ইত্যাদি নানা কারনে শিক্ষার্থী এমনকি অভিভাবকগণও
বর্তমান শিক্ষা নিয়ে ত্যাক্ত বিরক্ত ।শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে শিক্ষার সঙ্গে
থাকলেও গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিরানন্দ ও বোঝা সম এ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ
হারিহে ফেলছে ।ক্ষেত্র বিশেষে পরিবারের একজনের শিক্ষার পিছনে পরিবারের সবাইকে শ্রম
দিতে হচ্ছে, পেরেশানি ভোগ করতে হচ্ছে ।আর বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার এ বিশেষ দুর্বলতাগুলোর
সুযোগ নিচ্ছে এক ধরনের শিক্ষা ব্যবসায়ীগণ ।শিক্ষকগণ নিচ্ছে প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্যের
সুযোগ, প্রকাশকগণ নিচ্ছে নোট ও গাইড বই বাণিজ্যের সুযোগ । শিক্ষা এখন পুরোপুরি একটা
পণ্যের বৈশিষ্ট্য ধারন করে ফেলেছে ।
শিক্ষা
ব্যবসায়িক পণ্য হতে পারে না । কারন একটি পণ্যের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকার দরকার শিক্ষার
তা নেই । তাই কোন গবেষনাই শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে গণ্য করতে পারেনি । শিক্ষার উপকরন সমূহ
পণ্য, এ যুক্তিতে কেউ কেউ শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ভবাতে চান যা একটি ভুল ভাবনা ।বৈশিষ্ট্য
অনুযায়ী শিক্ষা একটি সেবা । পণ্য ও সেবার উপযোগিতা এক নয় । খুব সহজ একটি উদাহরনের সাহায্যে
বিষয়টি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারনা লাভ করা যেতে পারে । ধরুন একজন বিশ লাখ টাকায়
একটা গাড়ি কিনলেন । এখনে গাড়িটি পণ্য, ক্রেতা বিশ লাখ টাকা দিলেন গাড়িটি পেলেন । ক্রেতা
গাড়িটির অস্তিত্ব, গাড়ীর কালার, গাড়ির ডিজাইন ইত্যাদি দেখতে পারেন । গাড়িটি ধরতে পারেন,
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে পারেন, গাড়িটি রাস্তায় কেউ ভাংতেও পারেন । তাই গাড়ীর
এসব বৈশিষ্ট্যের কারনে গাড়ি পণ্য হিসেবে স্বীকৃত।
এবার
ধরুন গাড়িটির একটা চাকার হাওয়া কমে গেল, গাড়ির মালিক হাওয়ার দোকানে নিয়ে চাকায় হাওয়া
দিয়ে দোকানীকে বিশ টাকা দিলেন ।এখানে গাড়ির মালিক বিশ টাকা দিয়ে যা পেলেন তার কোন অস্তিত্ব,
কালার, ডিজাইন ইত্যাদি দেখলেননা । ধরতে পারলেননা, ভাংতেও পারলেননা । তাই এসব বৈশিষ্ট্যের
কারনে বিশ টাকা দিয়ে গাড়ির মালিক যা পেলেন তা সেবা হিসেবে স্বীকৃত । অর্থাৎ উপযোগিতা
প্রাপ্তির দিক থেকে একটি পণ্য, অপরটি সেবা ।আমরা যখন পণ্য ক্রয় করি তখন পণ্যের মূল্য
অনুযায়ী পণ্যটির সবকিছু কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেওয়ার সুযোগ থাকে, কিন্ত সার্ভিসের ক্ষেত্রে
এটা সম্ভব নয় ।একজন সার্ভিস গ্রহীতার সার্ভিস পুরোপুরি পাওয়াটা নির্ভর করে সার্ভিস
দাতার ইচ্ছার উপর ।
শিক্ষা
হলো যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে তীরস্কারের মাধ্যমে আবিস্কার করে, নিজের অজ্ঞতাকে
বিজ্ঞতায় পরিনত করে, নিজের পাশবিক প্রবৃত্তিকে মানবিক প্রবৃত্তিতে রুপান্তর করে, নিজের
অন্তর্নিহিত পশুত্বকে মনুষ্যত্বে রুপদান করে, নিজের লোভকে সংবরন করার ক্ষমতা অর্জন
করে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গীকে শাসন করার দক্ষতা অর্জন করে, নিজের চরিত্রের কালো দাগগুলি
আলো দ্বারা ধৌত করে, নিজের সার্বিক আচরনের ইতিবাচক স্থায়ী উন্নয়ন-বিকাশ ও পরিবর্তন
ঘটাতে সক্ষম হয় ।
শিক্ষাদান
হলো একটি সেবা । এটি একটি শিল্পও বটে । একজন সত্যিকারের শিক্ষক তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতিকে
শিল্পীর মত প্রতিনিয়ত শিল্পত্ব দান করেন । একজন সুশিক্ষক কখনও শিক্ষাদানের মত সেবাকে
মুদি পণ্যের ওজনের মত কতটুকু দেবেন এটা নির্ধারন করেননা । একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক
কখনও শিক্ষাদানের মত সেবাকে জমির আয়তনের মত কি পরিমান দিবেন সেটাকে সময়ের ফ্রেমে পরিমাপ
করেননা । একজন আদর্শ শিক্ষক কখনও শিক্ষাদানের মত সেবাকে ডিমের সংখ্যার মত কয়টি দিবেন
সেটা সংখ্যায় বিচার করেননা ।
শিক্ষাকে
বানাতে হবে শিল্প যেখানে উৎপাদন ও বিতরন হবে সেবা ।শিক্ষাকে পণ্যের কারখানা বানানোর
অসাধু চিন্তা বন্ধ না করলে, মুখে যে গুণগত শিক্ষার কথা বলছি তা এখানে নয় খুজতে হবে
অন্য কোন দেশে বা ভিন্ন কোন গ্রহে ।তাই শিক্ষা হোক সেবা শিল্প, পণ্যের কারখানা নয় ।
==
লেখকঃ এ এস এম কামাল উদ্দিন (সহকারী অধ্যাপক)