একটি
শিশু পৃথিবীতে আসে অনেক অনন্ত সুপ্ত সম্ভাবনা
নিয়ে ।ব্যতিক্রম বাদ দিলে ভুমিষ্ট হওয়ার পর চোখ মেলে যখন পৃথিবীকে দেখা শুরু করে তখন থেকেই তার প্রতিভা বিকাশের
আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ।ধীরে ধীরে তার মধ্যে অনুভূতি প্রবল হতে থাকে ।অন্যদের
কাজকর্ম বা চালচলন দেখে অনুকরন করা
শুরু করে।একদিন শিশু স্বাভাবিক শোয়া থেকে উপুড় হয় যা তার বসতে পারার আগ্রহ বা অনুভুতির প্রথম প্রচেষ্টা । একদিন শিশু নিজ থেকে বসতে
পারে যা তার দাঁড়াতে পারার আগ্রহের পূর্ব প্রচেষ্টা। একদিন শিশু নিজ থেকে
দাঁড়াতে পারে যা তার হাঁটতে পারার আগ্রহেরই প্রচেষ্টা ।একদিন শিশু নিজ থেকে হাঁটতে
পারে যা তার দৌড়াতে পারার আগ্রহের আরেক
প্রচেষ্টা ।এভাবে একটি শিশু তার নিজের প্রচেষ্টা আর মা বাবা ও পরিবারের অপরাপর সদস্যদের
অনুপ্রেরনা ও সহযোগিতার মাধ্যমে সে তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। কিন্তু সে তার অপার
সম্ভাবনার সঠিক ব্যবহার করতে পারবে কিনা তা অনেকাংশে নির্ভর করে তার পরিবারের পরিবেশ
ও পরিবারের সদস্যগণরে মানষিকতার ওপর। পরিবারের ইতিবাচক পরিবেশ যদি সে পায় তাহলে সে
সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে। আর যদি নেতিবাচক পরিবেশ পায় তাহলে তার মেধার বিকাশ সেভাবেতো
হয়ইনা না বরং মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় ।
পরিবার
হচ্ছে শিশুর প্রথম পাঠশালা ।তবে শুধু শিশুকালেই নয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধার সঠিক
বিকাশের জন্যে পরিবার গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা
পালন করতে পারে।অনেক মা বাবা ও পরিবারের অপরাপর সদস্যবৃন্দ আছেন যাঁরা শিশুকে স্বাধীনভাবে
কোন কাজ করতে দেননা।বিশেষকরে পরিবারের প্রথম সন্তান হলেতো কথাই নেই।কারন প্রথম সন্তান
থাকে মা বাবার স্বপ্নের ও অতি আদরের ।শিশু যখন নিজ থেকে কোন কিছু করতে যায় তখন অনেকেই
শিশুকে পড়ে যাওয়া বা ব্যথা পাওয়ার ভয়ে তাকে তা করতে না দিয়ে নিজেরাই করে দেন ।এধরনের
ক্ষেত্রে প্রায় শিশুরাই আত্ননির্ভরশীল
ও আত্নবিশ্বাসী হয়ে উঠেনা ।এক্ষেত্রে সকলেরই উচিত শিশুকে নিজ থেকে কাজ করতে দেয়া আর
পাশে থেকে তাকে কিছুটা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া এবং খেয়াল রাখা যাতে কোন বিপদ না ঘটে।
পরিবার
থেকেই শিশুরা জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ন শিক্ষা
পেয়ে থাকে, যেমন আচার-আচরণ, রচি-পছন্দ, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সৌজন্য, সামাজিকতা, আত্নবিশ্বাসী,
আত্ননির্ভরশীলতা
ইত্যাদি । এসব বিষয় সবটুকুই শিশু স্কুল থেকে শিখবে এমনটি আশা করা কোনো বাবা-মা’রই উচিৎ
নয় । শিশু স্কুলে থাকে অতি অল্প সময় যখন অধিকাংশ সময়ই কিছু নির্দিষ্ট পুঁথিগত সিলেবাসের
মধ্যে আবদ্ধ থাকে ।পুঁথিগত বিদ্যার বাইরের বিশাল জগতই শিশুর মেধা বিকাশ ও জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্র ।তাই হয়তো John Holt বলেছেন
“School is a place where children learn to be stupid”. তাই শিশুকে পড়ালেখার পাশাপাশি
খেলতে দেয়া, বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়া,
টিভি দেখতে দেয়া হলে তার মেধার যেমন পরিপূর্ন বিকাশ
ঘটবে তেমনি পুঁথিগত বিদ্যার বাইরের বিশাল জগত থেকে শিশু পরিপূর্ন জ্ঞানও অর্জন করবে
।অনেক সময় অনেক মা বাবা শিশুকে মোটেই খেলতে দেননা অথবা খেলা থেকে তুলে এনে শাসন করেন
এবং পড়তে বসতে বাধ্য করেন ।এসময় শিশুর কাছে অনুভুত হয় যে খেলাটা তার নিজের জন্য আর
পড়ালেখাটা মা বাবার জন্য । একারনে শিশু মনে করে তার খেলার অধিকার কেড়ে নিয়ে মা বাবা
তাদের নিজের স্বার্থে তাকে
দিয়ে লেখাপড়ার কাজটি করিযে নিচ্ছে ।এধরনের পরিস্থিতিতে শিশুর মধ্যে তার নিজের কাজ আর
খেলার প্রতিই বেশি আকর্ষন থাকে ।
সাধারণভাবে
আমাদের মা-বাবাদের ধারণা হলো সন্তান পড়াশুনায় ভালো ফলাফল (এ+, গোল্ডেন এ+) করতে পারলেই
সে মেধাবী হবে। তাই সন্তান যাতে পড়াশুনায় ভালো ফলাফল করে সেজন্য তাকে চাপ দেয়া হয়।
এতে করে সন্তান হয় পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে নইলে ভালো ফলাফল করার জন্য মানসিক
চাপ অনুভব করে। যার কোনটাই আসলে তার মেধার সঠিক বিকাশ ঘটাতে পারে না। মা-বাবা যদি পড়াশুনায়
ভালো ফলাফল করার জন্যে চাপ না দিয়ে সন্তানকে উৎসাহিত করেন, সন্তানের মধ্যে আগ্রহ তৈরি
করেন তাহলে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই
পড়াশুনায় ভালো ফলাফল করতে পারবে এবং মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানের
কিসে আগ্রহ আছে তা অনেক মা-বাবাই চিন্তা করেন না বরং শুধুমাত্র ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার
বানানোর স্বপ্নে তারা সন্তানের পড়াশুনা সহ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। যা আসলে
সন্তানের মেধার বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে । ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও পৃথিবীতে হরেক
রকমের পেশা আছে যার মাধ্যমে আজকের শিশু বড় হয়ে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারে।শিশুকে
তার জীবনের গতি প্রকৃতি নিধারন করতে মা বাবা ও শিক্ষকদের উচিত হরেক রকম পেশা সম্পর্কে তাকে ধারনা দেয়া যা থেকে সে নিজেই নিজের
ভবিষ্যত পেশা পছন্দ করে নিতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা “আম গাছকে চৌমাথায় দাঁড়
করিয়ে যতই ঠেংড়াইনা কেন সেটা প্রয়োজনের কাঁঠাল ফলাতে পারবেনা। বরং ঠেংড়ানি খেয়ে উল্টো
তার আম ফলাবার শক্তিটাও লোপ পেয়ে যাবে ’’। তাই ‘ উচ্চ শিক্ষিত মাছিমারা কেরাণী না হয়ে
স্বল্প শিক্ষিত আবিস্কর্তা হোক ’- এমন ইচ্ছাই মা বাবাদের থাকা উচিত।
উৎসাহ বা প্রশংসা শিশুর সাফল্য অর্জনে অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর সাফল্যে যেমন অভিনন্দন জানানো উচিত, তেমনি শিশু যখন ব্যর্থ হয় তখনও তাকে চেষ্টা চালিয়ে
যাওয়ার জন্য সমান উৎসাহিত করা উচিৎ। ব্যর্থতার উপর দাঁড়িয়ে সফল হওয়ার
স্বপ্ন শিশুদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। শিশুরা অনেক সময় সাধারন বিষয়ে ভুল করেও পরীক্ষায়
খারাপ করতে পারে। এক্ষেত্রে ফলাফলকে বড় করে না দেখে বরং কি শিখতে পেরেছে তাই বড় করে
দেখা উচিত। শচীন টেন্ডুলকার তার ওয়ান ডে ক্যারিয়ারের প্রথম দু’টি ম্যাচে শূণ্য রানে
আউট হয়েছেন ।মেসি জীবনে অনেকগুলো সহজ গোলের সুযোগ হাতছাড়া করেছেন । কিন্তু আজ তাঁরা
পৃথিবী কাঁপানো সাফল্য পেয়েছেন । অল্প কিছু ব্যর্থতা না থাকলে জীবনে অনেক সাফল্য আসবে কিভাবে ? মা বাবাকে শাসক
না হয়ে সন্তানের বন্ধু হতে হবে আর তাকে এ বিষয়টি বুঝাতে হবে যে চেষ্টা চালিয়ে গেলে
একদিন কাংখিত সাফল্য আসবেই।আর তাকে এ বিষয়টিও বুঝাতে হবে যে, সাফল্যের চুড়ান্ত ফলাফল
ভোগ করবে শিশু নিজেই।
“আমার শিশু আমাদের সম্পদ’’-এ কথাটা আমাদের
সকলকেই মনে রাখতে হবে ।তাই শিশুকে তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের
জন্য সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে জন্ম থেকে কমপক্ষে বিশ বছর বয়স পর্যন্ত তার সবকিছুতে পিতা-মাতাকে
সজাগ ও সুদৃষ্টি রাখতে হবে।
![]() |
আরও নিবন্ধ পড়তে ক্লিক করুন |