Wednesday, September 20, 2017

অনিয়মের স্বর্গে নিয়মের নরকবাস

‘‘বিবেক বাবু মারা গেছে সত্য বাবুর গায়ে জ্বর, নীতি বাবু দেশ ছেড়েছে বিবিসি’র খবর ।
উচিত বাবুর কানে তালা জুলুম বাবুর বেজায় জোর, শান্তি বাবু অশান্তিতে হবেনা আর হয়তো ভোর ।’’
উপরের কথাগুলো কে লিখেছেন জানিনা । জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কোন আইডিতে আমি পড়েছি বলে মনে পড়ছে । চাকুরির সুবাদে মাঝে মধ্যে শিক্ষকতার বাইরেও কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়।সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উপরে উল্লেখিত কবিতার কথাগুলো আমার বার বার মনে পড়েছে ।এটা ছিল এক ভিন্ন কিসিমের নতুন অভিজ্ঞতা । সত্য-মিথ্যা, নিয়ম-অনিয়ম, বিবেকবান-বিবেকহীন, শান্তি-অশান্তি, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, ভাল-মন্দ, নিরপেক্ষতা-পক্ষপাতিত্ব, গণতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র ইত্যাদি শব্দের সংজ্ঞা যেভাবে পড়েছি আর প্রাকটিস করেছি জীবনের এ পর্য়ায়ে এসে শব্দগুলিকে বড় অচেনা, বড় অপিরিচিত, বড় ওলট পালট, বড় বেখাপ্পা এমনকি বড়ই বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে।
প্রতিটি বিষয় বা বস্তুর সংজ্ঞা তৈরি হয় মূলত এর এক বা একাধিক আলাদা বৈশিষ্ট্য বা চরিত্রের উপর ভিত্তি করে। মানুষ এবং জানোয়ার বলতে আমরা যা বুঝি বা যে প্রাণীকে বুঝাই তা এ দুই প্রজাতির বৈশিষ্ট্য বা চরিত্রের কারনে ।এদের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করেই আমরা মানূষরাই মানুষ এবং জানোয়ারের পার্থক্য করতে পারি ।পবিত্র কোরআন শরীফে মানুষকেই বলা হয়েছে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ ।সত্য-মিথ্যা, নিয়ম-অনিয়ম, বিবেকবান-বিবেকহীন, শান্তি-অশান্তি, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, ভাল-মন্দ, নিরপেক্ষতা-পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি শব্দগুলির সংজ্ঞা মানুষকেই শিখতে হয়, জানতে হয় এগুলির মধ্যে পার্থক্য বুঝার জন্য ।আর মানুষ এগুলি সম্পর্কে জানতে বা শিখতে পারে পারিপাশ্বিক অবস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি থেকে ।

মানুষের মান সম্মান বোধ আর হুসজ্ঞান আছে বলেই ভাল মন্দের পার্থক্য জানতে হয়। জানোয়ারের এসব জানার প্রয়োজন হয়না তাই এদের জন্য কোন মসজিদ, মন্দির, মক্তব, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এসবের প্রয়োজন নেই ।এ কারনে জানোয়ারদের জীবন ‘খাওদাও আর ফুর্তি কর’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ।ভবিষ্যত বংশধরদের কী হবে এ চিন্তা জানোয়ারদের করার প্রয়োজন হয়না ।কিন্ত মানুষকে তা করতে হয় কারন একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার জীবদ্দশায় কৃতকর্মগুলোর পুরস্কার বা তিরস্কার ভবিষ্যত বংশধরদের বহন করতে হয় ।

আজ সত্য-মিথ্যা, নিয়ম-অনিয়ম, বিবেকবান-বিবেকহীন, শান্তি-অশান্তি, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, ভাল-মন্দ, নিরপেক্ষতা-পক্ষপাতিত্ব, গণতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র এ শব্দগুলোকে আমাদের চিন্তার ব্লেন্ডার মেশিনে এমনভাবে গুলিয়ে ফেলেছি যে এ শব্দগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্নয় করাটা রীতিমত এক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । এ জোড়া শব্দগুলো যেন নিজেদেরে মধ্যে এদের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র বদল করে নিয়েছে । এগুলি যেন পরস্পরের সাথে জায়গা বদল করে নিয়েছে । তাই এ শব্দগুলোকে আজ বড় অচেনা, বড় অপিরিচিত, বড় ওলট পালট, বড় বেখাপ্পা লাগছে ।আগের শেখা আর এখনকার দেখার মধ্যে এমন বিস্তর ফারাক যে মনের মধ্যে এমন প্রশ্নের উদয় হওয়া স্বাভাবিক যে কোনটি সঠিক? যা শিখেছি তা? নাকি যা বাস্তবে দেখছি তা?

আমার পরিচিত স্বল্প শিক্ষিত একজনের ধারনাটা ছিল এরকম যে, স্বার্থপর হওয়া ভাল কিন্ত নিঃস্বার্থ হওয়া ভাল নয় । কারন তার ধারনা স্বার্থপর মানে যিনি পরের স্বার্থে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করেন আর নিঃস্বার্থ মানে পরের স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে যিনি নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেন । জানার অজ্ঞতা থেকে তিঁনি বিষয়গুলোকে এভাবে লালন করলেও পরবর্তীতে তাঁর ভুল ভাঙ্গে এবং জানার অজ্ঞতার জন্য নিজে যেমন লজ্জিত বোধ করেন একই সঙ্গে নিজের অজ্ঞতাকে ধিক্কারও দেন । কিন্ত এখন আমরা যেন স্বজ্ঞানেই আমাদের শেখা সবকিছুকে ইচ্ছাকৃত বিকৃত করে উপস্থাপন করছি ।

এডলফ হিটলারের প্রধান সহযোগী জোসেফ গোয়েবল্‌স এর তত্ব অনুসরন করে আমরা একটা চরম মিথ্যাকে এমন জোরালো কন্ঠে বার বার উপস্থাপন করছি যা এক সময় সত্যের বাপ দাদায় পরিনত হচ্ছে। আমাদের কাছ থেকে বিষয়গুলো এভাবে শুনতে শুনতে আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাইন্ড সেটআপ যদি এমন হয় যে, তারা দিনকে রাত, তিলকে তাল, অন্যায়কে ন্যায়, মিথ্যাকে সত্য, অনিয়মকে নিয়ম, মন্দকে ভাল, অনুচিতকে উচিত, স্বৈরতন্ত্রকে গণতন্ত্র আর পক্ষপাতিত্বকে নিরপেক্ষ বলেই গ্রহন করছে তাহলে পৃথিবীর সভ্য জাতি বলে আমরা যাদের জানি তারাওতো আমাদেরকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে ।

শুরুতেই বলেছিলাম সাম্প্রতিক কালে একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে দায়িত্ব পালনের কথা ।এ এক নতুন কিসিমের ভিন্ন স্বাধের তিক্ত অভিজ্ঞতা ।দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হরেক রকম মানুষের মধ্যে প্রধানত তিন শ্রেণির মানুষকে আমি নতুনভাবে আবিস্কার করেছি ।এক শ্রেণির মানুষ দোর্দন্ড প্রতাপে মিথ্যাকে সত্য আর অন্যায়কে ন্যায় বানিয়ে পেশি শক্তিতে এগুলি প্রতিষ্ঠিা করে চলছে যা মনবৈকল্যের অধিকারি সমজাতীয়দের দ্বারা সহজে স্বীকৃতিও পাচ্ছে ।শিক্ষিত ও অশিক্ষিত এক শ্রেণির মানুষ এগুলি দেখেও না দেখার ভান করে এগুলি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে ।আর এক শ্রেণির অতি ভাল, অতি সরল ও অতি দুর্বল মানুষ আছে যারা নিরবে অশ্রু বিষর্জন ছাড়া প্রতিবাদের আর কোন ভাষা খুজে পাচ্ছেনা ।

সত্য বাবুরা যদি আর কখনও সুস্থ্য না হয়, নীতি বাবুরা নির্বাসনে যাওয়া যদি বন্ধ না করে, উচিত বাবুরা যদি আজীবন কানে তালা ঝুলিয়ে রাখে তাহলে হয়তো আর কখনও ন্যায়ের ভোর হবেনা ।তাহলে চরম অরজগতা আর অনিয়মের এ স্বর্গ ভাল মানুষদের জন্যতো হবে নিঃসন্দেহে নরকবাস ।
আরও নিবন্ধ পড়তে ক্লিক করুন
আরও ইভেন্ট দেখতে ক্লিক করুন