স্মৃতির পাতা থেকে | বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম অধ্যক্ষ এম এ বারী স্যার এর স্মরনে |

স্মৃতির পাতা থেকে
ঐতিহ্যবাহী বামনী ডিগ্রি কলেজ’র 
প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ
মরহুম এম এ বারী স্যার এর স্মরনে
==============================
দিনটি ছিল ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসের ২৩ তারিখ । তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা । সেদিন ছিল বামনী কলেজ প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রথম ইন্টারভিউ । শিক্ষক নিয়োগের ইন্টারভিউ হলেও আয়োজনের অবয়ব, লোকজনের উপস্থিতি, শতাধিক লোকের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা এসব কিছু দেখে সেটাকে যে কেউ ছোট খাটো বিয়ে বা আকিকার অনুষ্ঠানও মনে করতে পারতো । 
আজকের পূর্ন যৌবনা বামনী কলেজের জন্ম হয় মূলত বামনী হাই স্কুলের পুরোনো বাড়ীর এক পরিত্যক্ত কুড়ে ঘরে । অন্যের ঘরেই যার জন্ম তার জন্ম পরবর্তী সকল অনুষ্ঠান অন্যের ঘরেই হবে এটাই স্বাভাবিক । একারনে প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রথম ইন্টারভিউটি অনুষ্ঠিত হয় বর্তমানের বিশাল ক্যাম্পাসে অবস্থিত বামনী হাই স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সফিউল্যাহ বিএসসি এর কক্ষে । চাকুরির পরীক্ষা বললে এটা ছিল আমার দ্বিতীয় ভাইভা পরীক্ষা । 
কয়েকদিন আগে ১৬ তম বিসিএস এর মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশন ভবনে । আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন পিএসসি’র চেয়ারম্যান জনাব এস এম ফায়েজ যিঁনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছিলেন । ঐ বোর্ডের সদস্য ছিলেন চেয়ারম্যান সহ পাঁচজন । চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য কারও নামই জানা সম্ভব হয়নি । তবে অন্যান্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে আগে পরে আলাপকালে জেনেছি একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক,একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান, অপর দু’জনের পরিচয় জানতে পারিনি ।
১৬ তম বিসিএস ছিল সরকারি কলেজের শিক্ষক নিয়োগের স্পেশাল বিসিএস । প্রিলিমিনারী টেস্ট, সাইকোলজিক্যাল টেস্ট কোয়ালিফাই করে তবেই ভাইভা । তাই বামনী কলেজের সেদিনের শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা পরীক্ষাটা আমার কাছে ছিল ছাত্র জীবনের সাময়িক পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতির মতই মামুলি একটা বিষয় । বোর্ডের মুখোমুখি হওয়ার ডাক পড়লে যখন কক্ষের ভিতরে ঢুকি তখন ব্যাপারটা আর মোটেই মামুলি ব্যাপার বলে মনে হলোনা ।
একি ! এত লোক ! এলাহি কান্ড ব্যাপার ! প্রায় জন বিশেক বা তার কিছু বেশি লোকতো হবেই । কয়েক মুহুর্ত্বের জন্য ক্ষানিকটা ভীত হয়েছিালম । অবশ্য কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে ভাইভার জন্য মানষিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম । ঐ মজলিশের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি যার মুখভরা পাকা দাঁড়ি, কপালে অভিজ্ঞতার অনেকগুলি ভাঁজ, ইনকরা পরিপাটি পোশাক, মাথায় অল্প পরিমান কাঁচা-পাকা চুল, চেহারায় পান্ডিত্যের ভাব, আমার স্পষ্ট মনে আছে তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি বিনম্রভাবে অনুমতি চাইলাম-বসতে পারি স্যার ? তিঁনিই বললেন হ্যাঁ বসুন । কন্ঠের আওয়াজ শুনে মনে হলো ক্লান্তি আছে কিন্ত দেখে বুঝার উপায় নেই ।
সবার দিকে একনজর তাকিয়ে আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সরকারি মুজিব কলেজের বাংলা বিষয়ের অধ্যাপক জনাব শাহজাহান স্যার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মুজিব কলেজের অধ্যক্ষ, সফিউল্যাহ বিএসসি, নুর আহম্মদ চৌধুরী ও আলী আহম্মদ চেয়ারম্যান ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারিনি । আমি যাঁর অনুমতি নিয়ে বসেছিলাম শাহজাহান স্যার তাঁকেই বললেন স্যার আপনিই শুরু করুন ।শাহজাহান স্যারের বলার স্টাইল দেখে আমার বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয়নি যে তিঁনি শাহজাহান স্যারের চাইতেও বড় কিছু ।
ইত্তেফাক পত্রিকার বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, পৌরনীতি,সমাজ কল্যাণ, ইসলাম শিক্ষা, ইসলামের ইতিহাস, ব্যবস্থাপনা, হিসাববিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান এ ১২ টি বিষয়ের যেহেতু ইন্টারভিউ কল করা হয়েছে সেহেতু উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ১২ জন হবেন সাবজেক্ট এক্সপার্ট ।তাছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মুজিব কলেজের অধ্যক্ষ, সফিউল্যাহ বিএসসি, নুর আহম্মদ চৌধুরী ও আলী আহম্মদ চেয়ারম্যান সহ আরও ৪/৫ জন । সব মিলিয়ে বিশ জনেরও অধিক। এতবড় ভাইভা বোর্ড ফেস করতে গিয়ে যে কারও হাটু কাঁপাটা স্বাভাবিক ।
যথারীতি ভাইভা শেষে বের হলাম । কেউ একজন বললেন দুপুরে সবার জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা আছে তাই কেউ যেন না খেয়ে যাই ।নূর আহম্মদ চেীধুরীর বাড়ীতে খাওয়ার সময় পরিচিত হয়েই মূলত বুঝতে পারি ভাইভা বোর্ডে যাদের চিনতে পারিনি তাঁদের মধ্যে ছিলেন বামনী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী, সর্বজনাব মৌলভী জামাল উদ্দিন, আবু তাহের কোম্পানী, হাজী তোফাজ্জল হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন লাতু ও আরও কয়েকজন ।
ভাইভা বোর্ডে যাঁর অনুমতি প্রার্থনা করে বসেছিলাম তিঁনি আর কেউ নন, তিঁনি হলেন বামনী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম অধ্যক্ষ অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, সর্বজন শ্রদ্ধেয়, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অনেক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, ভীষন মজার মানুষ জনাব এম এ বারী । তিঁনি আজ আর বেঁচে নেই । আজ থেকে ষোল বছর আগে আজকের দিনে ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী তিঁনি পরলোক গমন করেন ।
৩১ আগস্ট ১৯৯৫ আমি বামনী কলেজে আনুষ্ঠানিক যোগদান করি ।আমাদের বসার জায়গা বলতে যা ছিল তা হলো বামনী হাই স্কুলের পুরোনো জায়গায় অবস্থিত মাটির ফ্লোর, চারদিকে বেড়া আর টিনের ছাউনিতে তৈরি পরিত্যক্ত ঘরের দেড়শ থেকে দু’শ বর্গফুটের একটি কক্ষ ।কক্ষটি ছিল অধ্যক্ষের কার্য়ালয় কাম শিক্ষক মিলনায়তন কাম অফিস । অর্থাৎ একের ভিতর তিন । সে কক্ষে ছিল অধ্যক্ষের জন্য একটি টেবিল ও একটি চেয়ার, একপাশে একটি স্টীলের আলমারি, শিক্ষকদের জন্য পুরাতন লক্কর ঝক্কর হাতাবিহীন ৮/১০ টা কাঠের চেয়ার আর হিসাব রক্ষকের জন্য ছোট্র একটি পুরোনো টেবিল । আধুনিক যুগে আমরা যেটাকে ওয়াশ রুম বলি তখন ওয়াশ রুমের বিকল্প ছিল এ ঘরটির উত্তর পাশে খোলা আকাশের নিচে কয়েকটি গাছ গাছালির আড়ালে পরিত্যক্ত ২/১ টি ওয়াল ঘেরা …….খানা । সে জায়গাটাকে আমরা সুন্দরের জন্য বাগান বাড়ি বলতাম।
বারী স্যারের সাথে যখন কর্ম জীবন শুরু করি তখন তাঁর বয়স ৬২ বছরের মত । আমাদের অনেকের বয়স ছিল তখন আনুমানিক ২৭ থেকে ৩০ এর মধ্যে । আমরা রুমে ঢুকতেই সালাম দিয়ে ঢুকতাম । আমার স্পষ্ট মনে আছে এ বয়সেও স্যার কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডসেক করতেন তারপর আমাদেরকে বসতে বলে নিজে বসতেন ।আমাদের মধ্যে যারা এ ভদ্রতাটুকু শিখেছে তা এম এ বারী স্যারের কাছ থেকেই ।
লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরা গ্রামে ১৯৩৫ সালে জনাব এম এ বারীর জন্ম । ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অনার্স ও একই বিষয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে এম এ পাশ করেন । পুরো কর্মজীবনই ছিলেন শিক্ষকতার সঙ্গে ।জীবনে প্রায় ১০ টি কলেজে অধ্যাপনা ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের যে অভিজ্ঞতা তিঁনি অর্জন করেছেন তা অন্যের জন্য ছিল অনুকরনীয়, অনুসরনীয় ও শিক্ষনীয় ।ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক হলেও প্রায় সকল বিষয়েই তাঁর দখল ছিল ।
১৯৯৪/৯৫ সালের সে জীর্নশীর্ন কুড়েঘর থেকে বামনী কলেজ আজ অট্রালিকায় ।বামনী কলেজের এমন সুদিন দেখলে দুর্দিনের কান্ডারী বারী স্যার নিশ্চয়ই খুশি হতেন । আজ বামনী কলেজের অনেক কিছু আছে কিন্ত নেই বারী স্যার, আরও নেই বামনী কলেজের দুর্দিনের আরও কয়েক বন্ধু মরহুম আলী আহম্মদ চেয়ারম্যান, মরহুম মৌলভী জামাল উদ্দিন, মরহুম আবু তাহের কোম্পানী প্রমুখ।
মরহুম এম এ বারী ছিলেন আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, বিনয়ী, সদালাপী, বন্ধুভাবাপন্ন, সর্বজন শ্রদ্ধেয়, ধর্মপরায়ন ও একজন মজার মানুষ । এমন একজন গুনীজনের সান্নিধ্যে অল্প ক’টা দিন থাকতে পেরে নিজেকে অত্যন্ত ধন্য মনে করছি। আজ ১৭ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মরহুম এম এ বারী স্যারের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি । একই সঙ্গে বামনী কলেজ পরিবারের যেসব সদস্য পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তাঁদের কর্মের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি ।প্রার্থনা করছি আল্লাহ যেন তাঁদের সকলকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন ।
 ( বি: দ্র: স্যারের কোন ভাল ও স্পষ্ট ছবি সংরক্ষনে না থাকায় অনেক পুরোনো একটি অষ্পষ্ট ছবি দিতে বাধ্য হলাম। আশাকরি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন । )

লেখক : এ এস এম কামাল উদ্দিন
শিক্ষক-বামনী ডিগ্রি কলেজ 
  
    

Popular posts from this blog

সরি (Sorry) এর ব্যবহার ও অপব্যবহার

রোহিঙ্গা বনাম নন এমপিও শিক্ষক || প্রসঙ্গ : মানবতা ||