Thursday, January 4, 2018

রোহিঙ্গা বনাম নন এমপিও শিক্ষক || প্রসঙ্গ : মানবতা ||

জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা
অনশনরত নন এমপিও শিক্ষক আন্দোলনের অংশবিশেষ।
মায়ানমারের  রাখাইন  রাজ্য  থেকে বিতাড়িত কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহন করেছে। মায়ানমার নিজ দেশের যে মানুষগুলোর উপর অমানবিক আচরন করেছে বাংলাদেশ অন্য দেশের (মায়ানমারের) সে মানুষগুলোর প্রতি মানবিক আচরন করেছে । তাদের থাকা,খাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদি সব ব্যবস্থাই সম্ভবমত করে যাচ্ছে বাংলাদেশ । বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের মানবিক সাহায্য প্রদানে অর্থ ব্যয় কর‌ছে । একদিকে তাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে তাদেরকে বাংলাদেশে পূনর্বাসনের চেষ্টাও চলছে । আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকার সহ কোটি বেকারের কর্ম সংস্থানকল্পে বিনিয়োগ না করেও মানবিক কারনে রোহিঙ্গাদের জীবিকা নির্বাহের দায়িত্ব বাংলাদেশ পালন করে যাচ্ছে ।
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পুনর্বাসনের জন্য ২,৩১২ (দুই হাজার তিনশত বার) কোটি টাকা বরাদ্দ করছে (সূত্রঃ দৈনিক সংগ্রাম ০৬/১২/২০১৭)। রোহিঙ্গাদের বিষয়টি সম্পূর্ন মানবিক তাই তাদের পূনর্বাসনের জন্য এরকম ব্যয় বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে । এ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আরও প্রমান হয় অন্য দেশের ৭/৮ লাখ মানুষের ভরন পোষন করার সামর্থ্য বাংলাদেশের রয়েছে ।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিনিয়ত টক শো গুলোতে বাংলাদেশের দূর্নীতির আলোচনাও হচ্ছে । এসব আলোচনা থেকে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো- বাংলাদেশ ব্যংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছে ৮৫০ কোটি টাকা । হলমার্ক কেলেঙ্কারীর মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের দূর্নীতি হয়েছে ৪৫০০ কোটি টাকা  । বেসিক ব্যাংক দূর্নীতি হয়েছে ৬৫০০ কোটি টাকা । ব্যাংকিং খাত থেকে মন্দ ঋন আর অবলোপনের নামে লোপাট হয়েছে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা । গত দশ বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ কোটি টাকা । শেয়ার বাজার থেকে লুট হয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা । এসব চুরি, দূর্নীতি সম্পর্কে খোদ মাননীয় অর্থমন্ত্রীই বলেছেন ‘ শুধু পুকুর চুরি হয়নি, সাগর চুরি হয়েছে ।’ মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী শিক্ষা কর্মকর্তাদের সহনীয় মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন । মিডিয়ার বদৌলতে এসব খবর কম বেশি সবাই জানেন ।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিভাবে সমৃদ্ধশালী হয়েছে বলেই রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা প্রদর্শন করতে পেরেছে, বাংলাদেশের আর্থিক সামর্থ্য আছে বলেই রোহিঙ্গাদের পূনর্বাসনের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প গ্রহন করা যাচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ তার চাহিদার চাইতেও বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে বলেই লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা দূর্নীতি আর পাচার হয়ে যাচ্ছে কিন্ত অর্থনীতির ভিত মোটেই দুর্বল হচ্ছেনা। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে । মানুষের আয় বেড়েছে ফলে ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে। মুদ্রা স্ফীতি বেড়েছে ফলে মূল্য স্ফীতিও বেড়েছে । নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সহ সব কিছুর মূল্যই কয়েকগুন বেড়েছে ফলে জীবন যাত্রার ব্যয়ও বহুগুন বেড়েছে ।     
এসব ব্যয় মেটাতে মানুষ শ্রম দিয়ে রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে । যেখানে অবৈধতার সুযোগ নেই সেখানে মানুষ বৈধভাবে রোজগার করে হিসাব কষে সংসার চালাচ্ছে । যেখানে অবৈধভাবে রোজগারের সুযোগ আছে সেখানে মানুষ এ সুযোগকে হাতছাড়া করছেনা । কেউ ইচ্ছা করে সৎ থাকার চেষ্টা করছে, কেউ সুযোগের অভাবে সৎ থাকছে । প্রায় সকল পেশায়ই নানাভাবে রোজগার বাড়ানোর উপায় থাকলেও শিক্ষকতা পেশায় এ সুযোগটি অত্যন্ত সীমিত । কোচিং বাণিজ্য, প্রাইভেট বাণিজ্য, ক্ষেত্র বিশেষে কর্মকর্তা পর্যায়ে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক দূর্নীতি বাদ দিলে অধিকাংশ শিক্ষকই সম্পূর্ন বৈধ রোজগারে জীবিকা নির্বাহ করেন।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় ৯০ শতাংশ সেবাই প্রদান করছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । এখানে রয়েছে প্রায় পাঁচ লক্ষ শিক্ষক কর্মচারী । আমাদের দেশে বেসরকারি পর্যায়ে এমপিও ভুক্ত ও নন এমপিও ভুক্ত এ দু’ধরনের শিক্ষক রয়েছেন । এমপিও ভুক্ত শিক্ষকগণ মূল বেতন ও নামমাত্র অন্য সুবিধাদি পেলেও অনেক সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকছে । নন এমপিও শিক্ষকগণ সরকার থেকে কোন আর্থিক সুবিধাই পাচ্ছেনা । দীর্ঘদিন যাবত মানবেতর জীবনযাপনকারী নন এমপিও এসব শিক্ষক বিগত প্রায় এক সপ্তাহ যাবত রাজধানী ঢাকায় খোলা আকাশের নিচে আমরন অনশন কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে । কিন্ত তাঁদের সমস্যা সমাধানের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোন আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছেনা । তাঁদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শনের এখনও পর্যন্ত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহনে কোন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসছেননা।
মনে হয় আমাদের মানবতার সবটুকু রোহিঙ্গাদের জন্য এমনভাবে হৃদয় নিংড়িয়ে দিয়েছি যেকারনে আমাদের জাতি গড়ার কারিগরদের প্রতি ন্যুনতম মানবতা দেখানোর মানবতাটুকু অবশিষ্ট রাখতে পারিনি। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে আমরা রোহিঙ্গাদের ভরন পোষন করছি কিন্তু কয়েকশ কোটি টাকা ব্যয় করে নন এমপিও শিক্ষকদের এমপিও ভুক্ত করতে পারছিনা। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে আমরা রোহিঙ্গাদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারছি কিন্ত মাত্র এক/দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করতে পারছিনা । রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা প্রদর্শনের প্রশ্নে বাজেট কোন বড় ইস্যু হচ্ছেনা, কিন্ত শিক্ষার মেরুদন্ড নামে কথিত শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তি আর শিক্ষা জাতীয়করণের প্রশ্ন আসলে আমরা বাজেটকে বড় ইস্যু করে দেখছি ।
আমরা সহোদর ভাই বোনদের কষ্ট দিয়ে বন্ধু বান্ধ‌বের সেবা করছি । তাহলে এটি আসলে আমাদের কেমন মানবতা ? এটি আসলে আমাদের কেমন সমৃদ্ধি ? এটি আসলে আমাদের কেমন উন্নয়ন ? আসলে কোন উন্নয়নের মহাসড়কে আমরা ?????? 
ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবের । কিন্ত নিজেদের নিকট থেকে ন্যায্য অধিকার আদায়ে জাতি গঠনের কারিগরদের ফুটপাতে শুয়ে আমরন অনশন করতে হবে, জাতি হিসেবে এটা বড় লজ্জার ।  জাতি গঠনের কারিগরদের প্রতি মানবিক আচরন প্রদর্শনের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক । শিক্ষকের ন্যায্য দাবি পূরন হোক । শিক্ষকের যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক ।

==লেখকঃ এ এস এম কামাল উদ্দিন (সহকারী অধ্যাপক)